এই ভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন সাতকড়ি পুততুণ্ড দারুণ আবেগের গলায় বলেছিল, তুমি আমার জন্যে এত করছ, কই কখনও তো কিছু চাও না
মনে মনে এই দিনটার জন্যে যেন অপেক্ষা করছিলাম। জানতাম, সাতকড়ি পুততুণ্ডের মুখ থেকে একদিন এই রকম একটা কথা বেরুবেই। কিন্তু আমি কোনও আগ্রহ দেখালাম না। অত্যন্ত নিরাসক্তভাবে বললাম, কী চাইব।
তোমার যা ইচ্ছা।
সাতকড়ি পুততুণ্ডকে দেখার পর থেকে আমার মনে হয়েছিল কিছু কিছু পয়সাওলা লোকের মধ্যে দু-একটা উইক স্পট মানে দুর্বল জায়গা থাকে। এদের কেউ চায় দারুণ নাম করতে, কেউ চায় প্রতিষ্ঠা, কেউ রাজনীতিক ক্ষমতা। এই উইকনেসগুলো কাজে লাগাতে পারলে কাজ গুছিয়ে নেওয়া যায়।
মনে মনে ভেবেও রেখেছি, আমার তো চাকরি-বাকরি হবে না, সার্ভিসের বয়স পারও হয়ে যাচ্ছে, যদি কিছু ক্যাপিটাল পাই বড়লোকদের দুর্বলতার ওপর বড় আকারে কাল্টিভেসন চালিয়ে যাব। এই ক্যালকাটা মেট্রোপলিটান ডিস্ট্রিক্টে কম করে এক কোটি লোক থাকে। তার ফাইভ পারসেন্ট যদি বড়লোক হয় তাহলে অঙ্কটা দাঁড়ায় পাঁচ লক্ষে। পাঁচ লক্ষের শতকরা বিশজনেরও যদি নানারকম দুর্বলতা থেকে থাকে তাহলে এক লক্ষ লোককে আলাদা করে নেওয়া যায়। আর এই লাখ লোকের টেন পারসেন্টকেও যদি ফঁদে ফেলতে পারি আমার লাইফ কেটে যাবে। আমি প্রায় ঠিকই করে ফেলেছিলাম, মানুষের দুর্বলতাগুলো নিয়ে একটা লার্জ স্কেল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলব। কিন্তু ক্যাপিট্যালটা পাওয়া যাচ্ছিল না। বললাম, আমার একটা বিজনেস স্টার্ট করার ইচ্ছে; কিন্তু টাকার জন্যে ওটা আটকে আছে।
কত টাকা হলে তোমার চলবে?
হাজার দশেক।
আমি এতটা আশা করিনি, কিন্তু পরের দিনই পুরো দশ হাজার টাকাই আমাকে দিয়েছিল সাতকড়ি পুততুণ্ড। এবং খুবই আশ্চর্যের ঘটনা, টাকাটা দেবার দুদিন বাদে চার ঘণ্টায় দু-দুবার করোনারি অ্যাটাক হয়ে লোকটা মারা গেল।
সাতকড়ি পুততুণ্ড মারা যাওয়ায় দুঃখ পেয়েছিলাম। লোকটার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ। কেননা সে-ই আমাকে মানুষের দুর্বলতার সন্ধান দিয়েছিল।
যাই হোক, সাতকড়ি পুততুণ্ডর সেই দশ হাজার টাকায় থিয়েটার রোডে প্রথমে একখানা ঘর নিয়ে বিজনেস স্টার্ট করেছিলাম। তারপর দ্রুত এক্সপ্যানসন করতে হয়েছে। এখন একটার জায়গায় চারখানা ঘর নিয়ে আমাদের অফিস। এক্সপ্যানসানের জন্যে লোকজনও নিতে হয়েছে। কলকাতা শহরে অফিস খুললেই চাকরির জন্যে ছেলেমেয়েরা কিউ লাগায়। গ্র্যাজুয়েট হলেই হল, আমার অফিসে কিছু কাজ তার জন্যে বরাদ্দ। তবে সারা বছরের জন্যে হয়তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে পারি না। পালা করে বছরে একমাস, দু-মাস কি ম্যাক্সিমাম তিন মাসের জন্যে ওদের কাজ দিয়ে থাকি। তিন মাস পর আবার নতুন ছেলে কি মেয়ে আসে। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে একটা চমৎকার বোঝাপড়া আছে। চাকরি-বাকরির যা বাজার তাতে এই রকম ভাগাভাগি করে না নিলে কী করে চলবে। মোদ্দা কথা হল, আমরা মোটামুটি ভালোই আছি, সুখেই আছি। আমাদের পরিবার সুখী পরিবার। আওয়ার্স ইজ এ হ্যাপি ফ্যামিলি।
হে মহান জনগণ, মানুষের দুর্বলতা নিয়েই আমাদের কাজ-কারবার। এই বিজনেসটা শুরু করার আগে ধারণা ছিল না, মানুষের কত রকমের উইকনেস থাকতে পারে। মনুষ্যজাতির দুর্বলতার ওপর ফসল ফলাতে গিয়ে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে আরো নতুন নতুন রাস্তা খুলে গেছে। এখন রোজই দেখি, শুধু দুর্বলতা নয়–মানুষের নানারকম অদ্ভুত অদ্ভুত হবি আর সাধ আছে, আছে অদ্ভুত ধরনের সব ক্ষ্যাপামি আর মানসিক বিকার। এগুলো আছে বলেই আমরা মোটামুটি চালিয়ে যাচ্ছি।
রোজই দেখি নানারকমের লোকজন আশে। এক কালের নামকরা কোনও অভিনেতা বা নৃত্যশিল্পী এখন তাকে লোকে ভুলে গেছে–এসে হয়তো বলেন তার জন্যে সম্বর্ধনার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্যে যত টাকা দরকার তিনি দেবেন। মোট কথা, সময় তাঁকে অচল পয়সার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিলেও তিনি পিপলের চোখের সামনে থাকতে চান। কোনও পয়সাওলা বাপ এসে ছেলের গতিবিধির ওপর নজর রাখবার জন্যে আমাদের সাহায্য চায়। কোনও ভাগ্নে আসে আমাদের দিয়ে তার মালদার শাঁসালো মামাকে ব্ল্যাকমেল করতে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিজনেস স্টার্ট করার পর প্রথম কিছুদিন ক্লায়েন্টদের মনোরঞ্জনের জন্যে আমরা কিছু কিছু কাজ করেছি। তবে এখন কিছুই করি না। আজকাল শুধু অ্যাডভান্সের টাকা নিই। অনেকের কাছ থেকে অ্যাডভান্স নিয়ে নিয়ে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা হাতে এসে গেলে কোম্পানির লালবাতি জ্বালিয়ে আবার নতুন কোম্পানি ফেঁদে বসি।
হে মহান জনগণ, আমার সব কথাই বলেছি। শুধু লতিকার প্রসঙ্গ ছাড়া।
লতিকা যদিও আমার চাইতে বছর দুয়েকের ঘোট, একসঙ্গে এম-এ পড়তাম। তারপর আমার বাবা ভরতচন্দ্র সরকার টুক করে মারা গেলে আমাকে ইউনিভার্সিটি ছাড়তে হয়েছিল। তারপর বেশ কয়েক বছর লতিকার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় লতিকার সঙ্গে তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা আমার হয়নি। তবে এক ধরনের বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে অন্য বন্ধুতের মতো লতিকার সঙ্গেও কফি হাউসে আড্ডা-টাড্ডা দিতাম। মাঝে মধ্যে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা যখন কঁক বেঁধে সিনেমা দেখতে যেতাম সেই দলে লতিকাও থাকত। ব্যস, ওই পর্যন্ত। অনেক কাল বাদে দারুণ নাটকীয়ভাবে আবার লতিকার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল।