কিন্তু এভাবে পোস্টার মেরে কিছু লাভ হবে কি?
তবে?
দুসেকেন্ড চিন্তা করে বলেছিলাম, আপনি যদি বিশ্বাস করে আমার ওপর দায়িত্ব দেন ফেমের ব্যাপারটা দেখতে পারি। আপনার জন্মদিনের উৎসবটাও অর্গানাইজ করতে পারি।
সাতকড়ি পুততুণ্ড মধ্যরাতের ফাঁকা রাস্তায় প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল, মনে হচ্ছে তুমি পারবে। কাল একবার আমাদের বাড়ি এসো না।
কালই?
হ্যাঁ হ্যাঁ, কালই। সাতকড়ি পুততুণ্ডর আর তর সইছিল না, এই নাও ঠিকানা। পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে আমাকে দিয়েছিল সে।
তখন আমি পুরোপুরি বেকার, কোনও কাজকর্ম নেই। কবি সাতকড়ি পুততুণ্ড আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করছিল। মনে আছে, পরের দিনই তার ভবানীপুরের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।
পুরনো আমলের প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি সাতকড়ি পুততুণ্ডর। শ্বেতপাথরের মেঝে, শ্বেত পাথরের সিঁড়ি, খড়খড়ির জানালা, রঙিন কাচের শার্সি, ঘরে ঘরে বার্মা টিকের ভারী ভারী খাট-আলমারি ইত্যাদি। সিঁড়ির বাঁকে বাঁকে বড় বড় দাঁড়ে কাকাতুয়া, ময়না নতুবা টিয়া পা দিলেই টের পাওয় যায় পয়সাওলা লোকের বাড়ি।
সাতকড়ি পুততুণ্ড আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। প্রথমে রুপোর থালায় ডজনখানেক বিরাট-বিরাট সাইজের সন্দেশ খাইয়ে নিজের লাইফ-হিস্ট্রিটা এক নিশ্বাসে মুখস্থ বলার মতো বলে গিয়েছিল। চার জেনারেসন ধরে তাদের বিলিতি মদের বিজনেস; লিসে স্ট্রিটে প্রকাণ্ড দোকান রয়েছে। সেখান থেকে বছরে কম করে তিন লাখ টাকা ইনকাম তবে মদটা ছোঁয় না সাতকড়ি পুততুণ্ড। তার একমাত্র নেশা কবিতা লেখা এবং এ-ব্যাপারে কিঞ্চিৎ নাম করা। কিন্তু নামটা কিছুতেই হয়ে উঠছে না। পনেরো-ষোলো বছর বয়স থেকে লিখছে সে; মোট ছহাজার কবিতা এর মধ্যে লিখে ফেলেছে। তবে তিরিশ পঁয়তিরিশটার বেশি এ পর্যন্ত ছাপা হয়নি। সবশুন্ধু তিনটি সন্তানের জনক সাতকড়ি পুততুণ্ড। দুটি মেয়ে, একটি ছেলে। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটি মদের দোকানে বসে। সুতরাং নির্বিঘ্নে কবিতার চাষ করে যেতে পারে সাতকড়ি পুততুণ্ড।
সংক্ষেপে অটোবায়োগ্রাফি শেষ করে সাতকড়ি পুততুণ্ড চাকরকে দিয়ে চল্লিশ-পঞ্চাশখানা চামড়া বাঁধানো মোটা মোটা কবিতার খাতা এনে আমার সামনে ডাঁই করে রেখেছিল। খাতাগুলোর, কোনওটার গায়ে সোনার জলে লেখা রয়েছে কবিতার ফুলবাগান, কোনওটার গায়ে কাব্য কুসুম, সৌরভ ইত্যাদি। তার তলায় লেখা আছে–কবি সাতকড়ি পুততুণ্ড।
পাতা উল্টে দু-একটা কবিতার নমুনা দেখতেই টের পাওয়া গিয়েছিল সম্পাদকার অন্ধ আর কালা না হলে এসব কোনওদিনই ছাপা হবে না। কিন্তু আমার পাকস্থলীতে তখন এক ডজন দামি সন্দেশ রয়েছে, তা ছাড়া জন্মদিন অর্গানাইজ করার দায়িত্ব নিয়েছি; সুতরাং মাথা ঝাঁকিয়ে কবিতাগুলোর তারিফ করেছি। সাতকড়ি পুততুণ্ড সেই বোধহয় প্রথম তার লেখার একজন সমঝদার পেয়েছিল। প্রায় হাতে চাঁদ পাবার মতো ব্যাপার। বিগলিত হেসে সে বলেছিল, তা হলে ভাই জন্মদিনের ব্যাপারে লেগে যাও। টাকা-পয়সা যা লাগে চেয়ে নেবে। মোটে লজ্জা করবে না।
সত্যি সত্যি কবি সাতকড়ি পুততুণ্ডর ষাট বছরের জন্মদিনটা দারুণভাবে অর্গানাইজ করেছিলাম। ডেকরেটরকে দিয়ে চমৎকার একখানা প্যাণ্ডেল বানিয়ে নাম করা নার্সারীর লোকদের দিয়ে পাতার ওপর সাদা ফুল গেঁথে লিখিয়ে নিয়েছিলাম কবি সাতকড়ি পুততুণ্ডর শুভ জন্মদিনে সবার নিমন্ত্রণ। সেই ফুলের লেখাটা প্যান্ডেলের সামনে টাঙিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের এন্টালিতে যে-সব ক্লাব আছে তাদের খাবার-দাবারের লোভ দেখিয়ে লরি বোঝাই করে জন্মদিনের সভায় নিয়ে এসেছিলাম। উঁচু একটা ডায়াসের ওপর নতুন ধুতি আর নতুন গরদের পাঞ্জাবি পরিয়ে, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গলায় জুইয়ের মালা দিয়ে সাতকড়ি পুততুণ্ডকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল সভার কাজ।
আমি যে কলেজে পড়তাম সেখানকার এক রিটায়ার্ড বাংলার প্রফেসারকে সভাপতি করে নিয়ে এসেছিলাম। ভদ্রলোক খুবই নিরীহ আর ভালোমানুষ। তাকে দিয়ে সাতকড়ি পুততুণ্ডর প্রতিভা সম্বন্ধে ঘন্টাখানেক বক্তৃতা দিইয়ে ছিলাম। তাছাড়া সাতকড়ির কিছু কবিতার আবৃত্তি এবং কিছু কবিতায় সুর দিয়ে গানও গাওয়ানো হয়েছিল। ফোটোগ্রাফারকে দিয়ে সভার নানা অ্যাঙ্গেল থেকে অনেক ছবিও তুলিয়েছিলাম। পরের দিন প্রায়-অচল এক খবরের কাগজের অ্যাসিস্টান্ট নিউজ-এডিটরের হাতে-পায়ে ধরে সভার বিবরণ আর সাতকড়ি পুততুণ্ডর একখানা ছবি ছেপে দিয়েছিলাম।
এই জন্মদিনের ব্যাপারে প্রচুর খরচ করেছিল সাতকড়ি পুততুণ্ড। কোনও কারণে একশো টাকা চাইলে লোকটা তিনশো বার করে দিয়েছে। হে মহান জনগণ, অকপটে স্বীকার করছি, এই জন্মদিনের ব্যাপারে নিট পাঁচশোটি টাকা আমার লাভ হয়েছিল।
যাই হোক, ওই দিনটার পর সাতকড়ি পুততুণ্ড আমাকে আর ছাড়ে না। তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল ইচ্ছা করলে আমি তাকে নোবেল প্রাইজও পাইয়ে দিতে পারি। সে যেমন আমাকে ছাড়েনি, আমিও চিটেগুড়ের গায়ে মাছির মতো তার গায়ে আটকে ছিলাম। প্রায়ই সাতকড়ি পুততুণ্ডর বাড়িতে কাব্য পাঠের আসর বসাতাম, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের ধরে মাঝে-মধ্যে তার দু-একটা কবিতা ছাপিয়ে দিতাম। অবশ্য নানা খরচের নাম করে সাতকড়ির কাছ থেকে টাকা বার করে টু পাইস নিজের পকেটে পুরে ফেলতাম।