একবার হল কী, পরীক্ষার শেষে একটাও টিউশানি নেই। কী করব, ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুম আসছিল না। মাথার ভেতর থেকে নাক-মুখ দিয়ে আগুন বেরিয়ে আসছিল। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে কিছুক্ষণ ছাদে ঘুরেছিলাম। তারপর নিজের অজান্তে কখন যে সিঁড়ি টপকে নীচে নেমে এসেছি, কখন এন্টালির আঁকাবাঁকা সরু গলি পিছনে রেখে লোয়ার সার্কুলার রোডে চলে গেছি, তারপর হাঁটতে হাঁটতে ল্যান্সডাউন রোডে–নিজেরই খেয়াল নেই। তখন অনেক রাত। রাস্তায় লোকজন চোখে পড়ছিল না। তবে দু-চারটে পুলিশ আর রাত-জাগা টলটলায়মান মাতালকে এখানে-ওখানে দেখা যাচ্ছিল। আর মাঝে মধ্যে ফাঁকা রাস্তায় ঝড় তুলে দু-একটা ট্যাক্সি কি প্রাইভেট কার উধাও হয়ে যাচ্ছিল।
ল্যান্সডাউন রোডের ফুটপাথ ধরে দূরমনস্কর মতো হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা অন্ধকার মোড়ের মাথায় আসতে চোখে পড়ল দশ-বারো বছরের একটা ছেলে দেয়ালে একটা পোস্টার মারছে।
পোস্টার-টোস্টারগুলো রাজনীতিক দলের ওয়ার্কাররাই বেশির ভাগ সময় মেরে থাকে। আর মারে সিনেমা-থিয়েটারওয়ালা কিংবা ছোটখাটো কোম্পানির লোকেরা। এতটুকু একটা বাচ্চাকে পোস্টার মারতে আগে আর দেখিনি। তা ছাড়া তার যা বয়েস, চেহারা এবং ময়লা ছেঁড়া খোঁড়া জামা-প্যান্ট–তাতে তাকে ভিখিরিদের ছেলে বলে সনাক্ত করা যায়।
কী পোস্টার মারছে ছেলেটা? কৌতূহলের বসে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। দেখলাম, সাদা কাগজের ওপর লাল কালিতে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে : কবি সাতকড়ি পুততুণ্ডর ষাট বছরের পদার্পণ। এই উপলক্ষে বারো নম্বর গোলোক চাটুজ্যে রোডে জাতির পক্ষ থেকে এক সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। দলে দলে যোগদান করুন।
বাংলা সাহিত্যের একটু-আধটু খবর আমি রাখি। বি-এ পর্যন্ত বাংলা ছিল আমার একটা সাবজেক্ট। তা ছাড়া গল্প-উপন্যাস কবিতা-টবিতা পড়ার ঝোঁক আছে। নিয়মিত একটা সাপ্তাহিক আরেকটা মাসিক আমি কিনে থাকি। কিন্তু সাতকড়ি পুততুণ্ড নামে কোনও কবির নাম আগে শুনেছি বলে মনে হয় না। ছেলেটাকে জিগ্যেস করলাম, এটা তোকে কে লাগাতে বলেছে?
খানিকটা দূরে একটা মোটর দেখিয়ে ছেলেটা বলল, একজন মোটা বাবু; ওই গাড়িতে বসে আছে। একটু থেমে আবার বলল, আমি রাস্তায় শুয়ে ছিলাম, বাবু আমাকে তুলে বলল, এ রকম দশটা কাগজ দেয়ালে সাঁটতে পারলে একটা টাকা দেবে। বলেই আবার পোস্টারটা লাগাতে শুরু করল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।
কিন্তু ছোট ছোট হাতে অত বড় একটা কাগজ ঠিক সামলাতে পারছিল না ছেলেটা। বললাম, দে, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।
ছেলেটা সন্দিগ্ধ ভাবে তাকাল, তুমি আমার টাকাটা নিয়ে নেবে না তো?
আরে না। তোর টাকা তুই পাবি। পারছিস না তো, তাই লাগিয়ে দিচ্ছি।
ছেলেটা এবার তার হাতের পোস্টারটা আমাকে দিল। আমি সেটা চমৎকার করে দেয়ালে সেঁটে দিলাম।
ছেলেটা বলল, একটা যখন লাগিয়ে দিয়েছ, এগুলোও লাগিয়ে দাও
দেখলাম আরো নটা পোস্টার রয়েছে, এবং সবগুলোতে একই কথা লেখা আছে। খানিকটা দূরে দূরে ভালো জায়গা দেখে পোস্টারগুলো মেরে দিলাম। সেই সঙ্গে মোটরটার ওপর লক্ষ্যও রেখেছিলাম; সেটা নিঃশব্দে অনুসরণ করছিল।
সুচারুরূপে পোস্টার লাগানোর কাজটি শেষ হয়ে যাবার পর ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে পড়েছিল, মোটরের দরজা খুলে গোলগাল থসথসে চেহারার একটা লোক বেরিয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি তাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম।
লোকটা আমার কাছাকাছি সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, ধন্যবাদ।
দশ ফুট হাঁটলেই যে লোক হাঁপিয়ে যায় তার ফুসফুসের জোর যে খুব বেশি নয়, বুঝতে পারছিলাম। যাই হোক, জিগ্যেস করেছিলাম, ধন্যবাদ কেন?
আমরা পা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত দ্রুত এক পলক দেখে নিয়ে তুমি কি আপনি বলবে, খুব সম্ভব কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়েছে লোকটা। তারপর বলেছে, এই যে তুমি পোস্টারগুলো মেরে দিলে সেই জন্যে।
ধন্যবাদের দরকার নেই। আপনি এই টাকাটা দিয়ে দিন। আমি সেই ছেলেটাকে দেখিয়ে বলেছিলাম।
হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই-পকেট হাতড়ে এটা মোটা পার্স বার করেছিল লোকটা; তার থেকে একটি টাকা বার করে ছেলেটাকে দিয়েছিল।
টাকা পেয়েই চলে গিয়েছিল ছেলেটা। আমারও আর দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। তবু আচমকা প্রশ্ন করে বসেছিলাম, কবি সাতকড়ি পুততুণ্ড কে?
আমি। কেন?
সেটাই আন্দাজ করেছিলাম। বলেছি, কিছু মন করবেন না, একটা কথা জিগ্যেস করব?
সাতকড়ি পুততুণ্ড বলেছে, অবশ্যই।
এভাবে পোস্টার লাগাচ্ছিলেন কেন?
সাতকড়ি পুততুণ্ড এর উত্তরে যা বলেছিল, তাতে আমার চোখের তারা স্থির হয়ে গেছে। চল্লিশ বছর বয়স থেকেই সে নিজের জন্মদিন করে আসছে কিন্তু স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে এবং চাকর-বাকর ছাড়া কেউ নাকি সে উৎসবে ঘেঁষে না। তাই এবার পলিটিক্যাল মিটিং-এর পোস্টারের মতো দেয়ালে দেয়ালে নিজের জন্মদিনের বিজ্ঞাপ্তি লাগিয়ে লোক জড়ো করতে চেয়েছে।
এমন এক্সপিরিয়েন্স আগে আর কখনও হয়নি। কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ আমার কী যেন হয়ে গিয়েছিল। বলেছিলাম, আপনি চান, জন্মদিনে প্রচুর লোকজন আসুক, হই-চই হোক, আপনাকে নিয়ে সবাই মাতামাতি করুক–এই তো?
ঠিক ধরেছ। দেখো, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার কিছু পয়সা-টয়সা হয়েছে। ছেলেবেলা থেকে পোয়েট্রি লিখছি কিন্তু ফেমটা তেমন হল না। আমার খুব ইচ্ছে ফেম হোক।