এদিকে ওয়ার্ল্ডের হালচাল বদলে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে সেকেন্ড গ্রেট ওয়ার এসে গেল। ইনফ্লেসনের বাজারে হু-হুঁ করে চাল ডাল জামা কাপড়ের দর চড়তে লাগল। বাবার মাইনেও কিছু কিছু বাড়ল। কিন্তু দুই বাড়ার মাঝখানে অনেকখনি ফারাক। দুটো এজ মেলাতে বাবার নাক দিয়ে ফেনা উঠে যেতে লাগল।
তারপর ওয়ার্ল্ড ওয়ার থামল, কিন্তু জিনিসপত্রের দাম সেই যে চড়তে শুরু করেছিল, সেটা ক্রমাগত আকাশের দিকে উঠতেই লাগল, উঠতেই লাগল। এদিকে দেশ স্বাধীন হল, আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পাকস্থলীর মাপও দিনকে দিন বাড়তে লাগল। লেট ভরতচন্দ্র সরকারের অবস্থাখানা বুঝে দেখুন। প্রকৃতির নিয়মে কিছুই নাকি ফাঁকা থাকার কথা না; সুতরাং আমাদের পাকস্থলিগুলো আর শূন্য থাকে কী করে? সেগুলো ভরাট করতে বাবার কণ্ঠার হাড় গজালের মতো ঠেলে বেরিয়ে পড়ল; বুকের মাপ ছইঞ্চি ছোট হয়ে গেল আর কঁচা চুলগুলো কবছরে পেকে সাদা ধবধবে হয়ে গেল।
তবু একটা কথা বলব, বাবার ওই রকম স্ট্রাগলের মধ্যেও একটু উচ্চাশা ছিল। সেটা তার ছেলেমেয়েদের ঘিরে। বাবা হয়তো ভেবেছিল নিজের জীবনটা কষ্টে-টষ্টে কাটল; ছেলেমেয়েগুলো যেন ভালো থাকে। তাই লোকটা করেছিল কী, নিজে অফিসে টিফিন না খেয়ে ট্রামে-বাসে না চড়ে সেই পয়সা বাঁচিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে মানুষ করে তুলতে চেয়েছে।
কিন্তু বিশ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনও তো বিগড়ে যায়; এ তো মানুষের শরীর। ফলতঃ যা হবার তাই হল। টার্গেটে পৌঁছুবার ঢের আগেই বাবা মুখ থুবড়ে পড়ল। সেই যে পড়ল আর উঠল না।
ভরতচন্দ্র সরকার তো নামের আগে একখানা চন্দ্রবিন্দু যোগ করে বেঁচে গেল। কিন্তু আমরা? আমি তখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে পড়ি। আমার পর দুবছর বাদে একটা করে ভাই অথবা বোন। আমরা দুই ভাই, তিন বোন। আমি ছাড়া বাদবাকিরা পড়াশোনা করছে।
মৃত্যুর আগে বাবা প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকাপয়সা তুলে একটা বোনের বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিল। ব্যস, ওই পর্যন্ত। তার মৃত্যুর পর, যেহেতু আমি বড়, বাকি তিন ভাই-বোন এবং বিধবা মায়ের দায়িত্ব এসে পড়ল আমার কাঁধে। অথচ একটি পয়সা রেখে যায়নি বাবা।
অতএব প্রথম ধাক্কাতেই আমাদের পড়াশোনা গেল বন্ধ হয়ে। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি। টিগ্রিগুলো পকেটে পুরে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ আর ডালহৌসিতে যত আফিস-টাফিস আছে সব জায়গায় ঢু মারতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও একটা দরজা খুলল না। যেখানেই যাই সেখানেই এক রেকর্ড বেজে যায়–নো ভ্যাকান্সি।
দেখতে দেখতে দু-তিনটে বছর কেটে গেল। এর মধ্যে ডিগ্রি-টিগ্রিগুলো পকেটে ঘুরে ঘুরে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে গেছে; আমার গাল বসে গেছে, চোখের কোণে কালি পড়েছে।
হে মহান জনগণ, নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন লোয়ার মিডিল ক্লাসের একেবারে নীচের স্তরের মানুষ আমরা। যার বাবা সামান্য একজন লেজার কিপার ছিল, যার কোনও জোরালো রকমের মামা বা মেসো নেই তার পক্ষে চাকরি জোটানো অসম্ভব। আমারও চাকরি-টাকরি হল না।
এর ফলে আরো অনেক ফ্যামিলিতে যা-যা ঘটেছে আমাদের বেলাতেও তাই তাই ঘটল। হে মহান জনগণ, আপনারা জানেনই কী ঘটতে পারে। তাই অংশটা খুব সংক্ষেপেই সেরে ফেলা যাক। আমার একটা বোন চাকরির খোঁজে রোজ দুপুরে বেরিয়ে যেত; ফিরত মাঝরাতে। ও কোথায় যায় আন্দাজ করলেও আমার মুখ বুজে থাকতাম। তারপর বলা নেই কওনা নেই, দুম করে মেয়েটা একদিন আত্মহত্যা করে বসল। আর তখনই জানা গেল, সে তিন মাসের প্রেগনান্ট ছিল। কী বোকা মেয়ে! আজকাল কত ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট বেরিয়েছে, তার কোনও খোঁজই রাখত না! হে মহান জনগণ, এই কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে ও সংসার বাঁচাবার জন্যে ঘরের বাইরে পা দিয়েছিল! যাকগে, আমার আরেকটা বোন একদিন একটা পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল। আর ছোট ভাইটা স্মাগলার না ওয়াগন-ব্রেকার কাদের দলে যেন ভিড়ে বাড়ি ছাড়ল। লস্ট জেনারেসন বলে একটা কথা আছে না, ও তাদেরই একজন হয়ে গেল। বাকি রইলাম মা আর আমি। মা খুবই নরম ধাতের মানুষ। এই সময়ের পক্ষে একবারেই অচল। এখন বেঁচে থাকতে হলে নার্ভগুলোকে স্টিল দিয়ে তৈরি করে নিতে হয়। কিন্তু মায়ের নার্ভ ছিল মোমের তৈরি; একটুতেই গলে গেল। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে এতগুলো পারিবারিক বিপর্যয় দেখে দেখে ভদ্রমহিলার মাথাটা একেবারে গোলমাল হয়ে গেল। কিছুদিন বাড়িতে রেখে ট্রিটমেন্ট করার চেষ্টা করেছিলাম। কিছুতেই কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত মাকে মেন্টাল হসপিটালেই পাঠাতে হল।
হে মহান জনগণ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। চাকরি-বাকরি না পেলেও অনেকগুলো টিউশনি পেয়েছিলাম। সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত হোল ক্যালকাটা ঘুরে তাই করে যেতাম। কিন্তু মেন্টাল হসপিটালে মাসে দুশো করে টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে হাতে কিছুই প্রায় থাকত না। ফলে কর্পোরেশনের কলের বিশুদ্ধ জল খেয়ে বেশির ভাগ দিন আমার কেটে যেত।
এদিকে টিউশানি-ফুইশানিগুলো একেবারে মরসুমী ব্যাপার। পরীক্ষার সীজনে আঁক বেঁধে যেমন আসত, আবার চলে যেত। তখন আমি দারুণ ঝামেলায় পড়ে যেতাম। বাড়িভাড়া বাকি পড়ত, ঠিক সময়ে মেন্টাল হসপিটালে টাকা দিতে পারতাম না। মোটামুটি এইভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল।