লোকটা বলল, রহনে দেওয়া শালেকো। শালে হামারা জান বরবাদ কর দিয়া।
এক নিশ্বাসে লোকটা যখন নিজের ছেলে সম্বন্ধে দু-দুবার শালা শব্দটা উচ্চারণ করল তখন আমার আর বলবার কিছু নেই। সুতরাং আমি তেতলায় উঠে এলাম। এখানে কারোকেই দেখা গেল না। তবে তিন পরিবারের দুটো ঘরেই আলো জ্বলছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় কেউ ঘুমোয়নি। এই মুহূর্তে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ঘরে প্রচণ্ড জোরে জ্যাজ বাজনার রেকর্ড বাজছে। জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম ওই ফ্যামিলির দুই মেয়ে বাজনার তালে তালে নেচে যাচ্ছে; তাদের প্রচণ্ড মোটা মা আর বাবা চেয়ারে বসে সিগারেট খেতে খেতে মেয়েদের নাচ দেখছে। উল্টোদিকে শিখেদের ঘরে তারস্বরে বিবিধ ভারতী চলছে। এই দুটো ফ্যামিলি পাল্লা দিয়ে সারাদিন রেডিও আর জ্যাজ চালায়।
অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বড় মেয়েটা, নাম যার ডরোথি; কোন একটা ব্রিটিশ কোম্পানির টেলিফোন অপারেটর–আমাকে দেখলে এখনই মেয়েটা ছুটে আসবে; হাত ধরে টানাটানি শুরু করবে। মেয়েটা আমাকে ভীষণ লাইক করে। সবার সামনেই জড়িয়ে-উড়িয়ে ধরে এমন কাণ্ড করে বসে যাতে আমি যে আমি; আমার পর্যন্ত নাক-মুখ দিয়ে ঝুঁজ বেরুতে থাকে। হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহান জনগণ, ডরোথির কাছ থেকে আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই-এখনও পা টিপে টিপে তেতলার ছাদে উঠে এলাম।
এই গোটা ছাদটা দুখানা অ্যাসবেস্টসের ঘর সুন্দু পুরোপুরি আমার দখলে। এখান খেকে প্রকাণ্ড আকাশ আর গ্রেট ক্যালকাটা মেট্রোপলিসের অনেকখানি স্কাইলাইন চোখে পড়ে। যাই হোক, তালা খুলে আলো জ্বেলে ফেললাম। একটা ঘরে ঢুকলেই ভেতরের দরজা দিয়ে আরেকটা ঘরে যাওয়া যায়।
আমার এই ঘরটার একধারে পুরনো আমলের একটা ধবধবে বিছানা পাতা রয়েছে। আরেকধারে ছোট আলমারি, টেবল, বুক শেলফে কিছু বই-টই, দেয়ালে আয়না এবং একটা র্যাকে সেভিং বক্স, চিরুনি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার খাটের তলায় তেলচিটে আরেকটা বিছানা রয়েছে। সেটা চার্লির। ব্রিফকেসটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে জুতা খুলে ফেললাম। তারপর মাঝখানের দরজা দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলাম। এটাকে মোটামুটি কিচেন-কাম-ডাইনিং রুম বলা যেতে পারে। চোখে পড়ল টেবলের ওপর আমার রাতের খাবার ঢাকা দেওয়া রয়েছে। এ নিশ্চয়ই চার্লির কাজ। রোজই আমার জন্যে রাতের খাবার তৈরি করে বিছানা-টিছানা পেতে, ময়লা ট্রাউজার-ফাউজার থাকলে ধুয়ে ইস্তিরি করে রেখে যায় সে।
চার্লির সঙ্গে ক্বচিৎ কখনো আমার দেখা হয়। সে কখন আসে কখন যায় আমি জানি না। তবে একবার আসেই। এবং রান্না-বান্না থেকে ঘরের যাবতীয় কাজ-কর্ম করে রেখে যায়। আমার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। চার্লি একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান চোর! সারারাত কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় নিজের ধান্দায় ঘুরে বেড়ায় সে। আর মওকা পেলেই সুরুত করে কোনও বাড়িতে ঢুকে কিছু হাতের কাজ করে ফেলে। মাঝে মাঝেই চার্লি ধরা পড়ে; তখন কিছুদিনের জন্যে জেলে গিয়ে মুখ বদল করে আসে। সেই সময়টা আমার ভীষণ অসুবিধা হয়।
আগেই বলেছি, চার্লির আসা-যাওয়ার ঠিক-ঠিকানা নেই। আর সে আমার মতো সিঁড়ি বেয়েও আসে না। হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহান জনগণ, আমার এই ঘরের ডানদিকের জানালার দুটো শিক আলগা। ও দুটোর ওই অবস্থা চালিই করে রেখেছে। ওই জানালাটার ধার ঘেঁসে একটা ঢ্যাঙা চেহারার নারকেল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। চার্লি যখনই আসুক, নারকেল গাছ বেয়ে আলগা শিক দুটো খুলে ভেতরে ঢোকে। তারপর শিক দুটো আবার জায়গা মতো বসিয়ে দেয়। যায়ও সে ওইভাবেই। কাজেই, ছাদের দিক থেকে তালা লাগানো থাকলেও তার যাতায়াতের কোনও অসুবিধা ঘটে না। কিন্তু চার্লি কথাও এখন না।
থিয়েটার রোডে আমার অফিস থেকে বেরিয়ে মনোবীণা সান্যালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভদ্রমহিলা এক কাপ চা-ও খেতে বলেননি। অবশ্য ওঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনও রেস্তোরাঁ কি খাবারের দোকানে ঢুকে কিছু খেয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু মনোবীণা সান্যাল যে কাজের দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়েছিলেন সেটা আমাকে এমনই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে খাওয়ার কথা মনে পড়েনি। এখন টের পাচ্ছি প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে।
কিচেন-কাম-ডাইনিং রুমে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকলাম না। বেড রুমে ফিরে দ্রুত একটা তোয়ালে কাঁধে চাপিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম।
দশ মিনিটের ভেতর হাত-মুখ ধোয়া এবং খাওয়ার পালা চুকিয়ে লাইট-টাইট নিভিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম।
ঘরের ভেতর অন্ধকার। কিন্তু খোলা জানালা দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত কলকাতার স্কাইলাইন দেখা যাচ্ছে। আর চোখে পড়ছে নীচে রাস্তাঘাট, কর্পোরেশনের আলো। ট্রাম বাস এবং অন্যান্য গাড়ি চলার শব্দ ভেসে আসছে। সারাদিন আমার নানারকম ঝঞ্ঝাটের ভেতর দিয়ে কাটে। রাত্রে ফিরে এসে শোওয়ামাত্র আমার চোখ বুজে যায়। কিন্তু একেকদিন কী যে হয়, কিছুতেই ঘুমোতে পারি না আজ আমার ঘুম এল না।
ঘুম না এলে কেন না জানে, আমার ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের এই লাইফ, তার ব্যাকগ্রাউন্ডে হুড়মুড় করে আমার চোখের সামনে এসে হাজির হয়। উজান টানে ভাসতে ভাসতে তখন আমি পিছন দিকে ফিরে যাই।
.
হে মহান জনগণ, আমার বাবা ভরতচন্দ্র সরকারকে দিয়েই শুরু করা যাক। বাবা ইংরেজ আমলে কোনওরকমে আপার প্রাইমারিটা পাশ করে মার্চেন্ট ফার্মে সাতাশ টাকার একটা লেজার-কিপারের চাকরি জোটাতে পেরেছিল। তখন টাকার দাম ছিল; সাতাশ টাকায় চলে যেত। সেই চাকরির ওপর ভরসা করে দুম করে একটা বিয়ে করে ফেলেছিল বাবা। তারপর? তখন তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং ছিল না, দো আউর তিন বাচ্চের স্লোগানও ওঠেনি। জীব দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি–এই প্রোভাবখানা চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখে পটাপট পাঁচটি ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে বসল।