আমি থাকি এন্টালিতে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মনোবাণী সান্যালের বিরাট কম্পাউন্ডওলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় খানিকক্ষণ এলোমেলো ঘুরলাম। তারপর সাড়ে দশটার সময় এন্টালিতে নিজের কোটরে ফিরে এলাম।
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, আপনাদের কেউ যদি আমার সঙ্গে এসে থাকেন অনুগ্রহ করে এই বাড়িটার অবস্থান লক্ষ্য করুন।
চারধারে টালি আর টিনের চালের ঘিঞ্জি বস্তি; মাঝখানে ধসে পড়া যে তিনতলা বাড়িটা কোমর বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, খুব সম্ভব কলকাতার আদি পিতা জব চার্নক নিজের হাতে তার ভিত গেঁথেছিলেন। এটাই আমার হোম–সুইট হোম। এই বাড়িতেই একদা আমি জন্মেছিলাম। জন্মের পর থেকে দেখে আসছি এ বাড়িতে কখনও হোয়াইট ওয়াশ করা হয়নি; সাঁইত্রিশ বছর ধরে বাড়িটা এই রকম বিপজ্জনক ভাবে হেলে রয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য কাণ্ড, বাড়িটা কিন্তু পড়ে না।
এটার আদি রঙ কী ছিল বুঝবার উপায় নেই। রোদে আর বৃষ্টিতে দেয়ালের আস্তর খসে গিয়ে কবেই ইট বেরিয়ে পড়েছে। এখন তার ওপর তিন ইঞ্চি পুরু কাঁচে শ্যাওলা জমে আছে। দেয়াল আর ভিতের ভেতর নানা আগাছা পঞ্চম বাহিনীর মতো শেকড় চালিয়ে ধ্বংসের কাজ ক্রমাগত এগিয়ে রাখছে। এরই ছাদে অ্যাসবেস্টসের দু-খানা ঘর নিয়ে আমি বসবাস করি।
এ বাড়ির প্রত্যেক ফ্লোরে ছটা করে কামরা। তিনটে ফ্লোরে আঠারোখানা কামরায় মোট নটি ফ্যামিলি থাকে। ফ্যামিলি পিছু এখানে দুটো করে ঘর। এ বাড়ির একতলায় থাকে একটা চীনা ফ্যামিলি, একা বিহারি মুসলিম ফ্যামিলি, আর থাকে দুটো কাবলিওলা। কাবলিওয়ালাদের অবশ্য স্ত্রী ছেলেমেয়ে নেই। দোতলায় আছে একটা তেলেঙ্গী, একটা মারোয়াড়ি আর একটা বর্মিজ ফ্যামিলি। তিনতলায় থাকে একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, একটা নেপালি আর একটা শিখ ফ্যামিলি। আর এই বিশ্বসুদ্ধ জাতির মাথায় অর্থাৎ ছাদের ওপর থাকি আমি।
আমার যারা প্রতিবেশী তাদের সব আজব জীবিকা। কেউ সুদে টাকা খাটায়, কেউ রেসের বুকী, কেউ ড্রাইভার। কেউ সদর স্ট্রিটে মেয়েমানুষের দালাল, কেউ মাংসের দোকানদার, কেউ চামড়ার ব্যবসায়ী..ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এক জায়গায় সবার আশ্চর্য ছিল। বাংলা মদটি সকলেই নিয়মিত পান করে থাকে।
এমন একটি ইউনাইটেড নেশনের হেড কোয়ার্টার আমি কেমন করে খুঁজে পেলাম? এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় এ কৃতিত্ব আমার নয়। আমার জন্মদাতা পিতা ঈশ্বর ভারতচন্দ্র সরকার এটি খুঁজে বার করেছিল এবং আজ থেকে চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর আগে মাত্র দশ টাকা ভাড়ায় এখানে এসে ম্যারেড লাইফ স্টার্ট করেছিল। তিন সাড়ে তিন যুগ আগের সেই দশ টাকা ভাড়া বেড়ে এখন পঁচিশ টাকায় উঠেছে। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ভাড়াটে বাড়ির দু-খানা অ্যাসবেস্টসের ঘর ছাড়া আর কিছুই পাইনি। মার পঁচিশ টাকায় ওয়ার্ল্ডের সেভেন্থ সিটি এই কলকাতার হার্টের কাছাকাছি তেতলা বাড়ির ছাদে যে থাকতে পারছি, একমাত্র এই কারণটার জন্যে আমি বাবার কাছে কৃতজ্ঞ। যাক গে, বাবার কথা এখন নয়-পরে।
এখন এই রাত সাড়ে দশটায় বাড়িটার ভেতর ঢুকে দেখলাম একতলায় বিহারি মুসলমান আর কাবলীদের ঘরে এর মধ্যে আলো নিভে গেছে। তবে চীনেরা একটা খাঁটিয়ায় বসে সপরিবারে যুগপৎ রাতের খাবার আর বাংলা মাল খাচ্ছে। ওদের ফ্যামিলির কর্তা–নামটা কিছুতেই মন থাকে না; বাজারে ওদের জুতোর দোকান আছে-আমাকে দেখে রক্তাভ হলদে মুখে একটু হাসল। বলল, রিতারনিং? লোকটা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে; হিন্দিটা অবশ্য অনর্গলই বলে। তবে উচ্চারণ আধো-আধো; অনেকটা বাচ্চাদের মতো সব চীনারই উচ্চারণ বোধ হয় এইরকম।
যাই হোক আমিও একটু হাসলাম, ইয়েস। এভরিথিং অলরাইট?
ইয়েস। কাম অন, জয়েন আস।
ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আজ নয়–আরেকদিন ওদের সঙ্গে খাব। তারপর বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দোতলার বাঁকে এসে দেখলাম দোতলার বর্মিজ ফ্যামিলির বড় ফেলে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দোতলার বাঁকে এ ছেলেটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার মুখ থেখে ভক ভক করে দিশি মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছে। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে কম করে তিনশো ষাট দিন রাত্রি দশটা থেকে বারোটার মধ্যে ওই ছোকরাকে সিঁড়ির মুখে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
ওর পাশ কাটিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। এই মুহূর্তে এখানকার দুই পরিবার মারোয়াড়ি আর তেলেঙ্গীদের মধ্যে কোনও বিষয়ে তুমুল ঝগড়া চলছিল। এ বাড়িতে এই রকম ঝগড়া কোনও না কোনও ফ্লোরে সব সময়ই চলতে থাকে। আঠারোটা ঘরে বিশ্বসুদ্ধ জাতির সহাবস্থান ঘটলে এই রকম কাণ্ডই হয়। এটা আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। ওদের ভেতর দিয়ে আমি বর্মিজদের দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে খুলে হেড অফ দি ফ্যামিলি, তার পিছনে তার গিন্নী এবং গিন্নীর পিছনে একগাদা কাচ্চাবাচ্চার মোঙ্গলীয় মুখ উঁকি মারল।
ফ্যামিলির কর্তা ভীতভাবে জিগ্যেস করল, ক্যা হুয়া, ক্যা হুয়া
লোকটা কী করে, সংসার কী ভাবে চালায়–সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছরেও আমি জানতে পারিনি। কেউ বলে লোকটা চোরা চালানদার, কেউ বলে কোকেনের ব্যবসা করে। অসটেনসিল মিস অফ ইনকাম বলতে যে কথাটা আছে সেটা ওর নেই। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি লোকটা সর্বক্ষণ সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। বললাম, তোমার বড় ছেলে সিঁড়ির মুখে নেশার ঘোরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।