সোমা হাঁ-নার মাঝামাঝি মাথা নাড়ল, মুখে কিছু বলল না। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, পলকহীন তার দিকে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়, তাদের সঙ্গে সঙ্গে সুটকেশ-টুটকেশ নিয়ে এ ঘরে ঢুকে পড়েছিল সে। চোখাচোখি হতেই অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল সোমা।
তপতীর মা বললেন, আচ্ছা আমি এখন যাই, তোমরা বেশি দেরি কোরো না
তিনি চলে গেলেন। দোলন-ঝুলন-পিন্টু তার সঙ্গে গেল।
একদৃষ্টে সোমাকে লক্ষ্য করছিল মৃন্ময়; নিঃশব্দে মালপত্র নামিয়ে রেখে সোমাকে দেখতে দেখতে সেও চলে গেল।
.
০৪.
স্নান-টান সেরে তপতী সোমাকে খাবার ঘরে নিয়ে এল। এ ঘরটাও বেশ বড়সড়। মাঝখানে প্রকাণ্ড টেবল। টেবলটাকে ঘিরে সিংহাসনের মতন অনেকগুলো চেয়ার। মাথার ওপর নাইনটিন ফরটি মডেলের ফ্যান ঘুরছে।
সোমারা আসবার আগেই দোলন ঝুলন পিন্টু এবং মৃন্ময় ডাইনিং রুমে এসে বসে ছিল। তপতীর মা-ও ছিলেন ও ঘরে।
তপতীদের দেখেই মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, তোদের জন্যে ঝাড়া একটি ঘন্টা বসে আছি। তাড়াতাড়ি বসে পড় বাপু। খিদেয় পেট চুঁই ছুঁই করছে।
বসতে বসতে তপতী বলল, আমাদের জন্যে বসে থাকতে কে বলেছিল? তুমি খেয়ে নিলেই পারতে
খেয়ে নেব! বেশ বলেছিস! বাড়িতে গেস্ট আছে না–
ও বাবা-তপতী চোখ গোল করল। ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, তুমি এত ফর্মালিটি-টর্মালিটি কবে থেকে মানতে শুরু করেছ?
মৃন্ময় দুই হাত চিত করে কাঁধ ঝাঁকাল, ফর্মালিটির ধার ধারতে আমার বয়েই গেছে। আমি তো খেতেই চেয়েছিলাম–ফুলমাসি দিল না যে। বলল, তোর বন্ধু কী ভাববে–
সোমার মুখ লাল হয়ে উঠল।
তপতীর মা হাসতে হাসতে উঠে পড়লেন, ভাববেই তো। আচ্ছা তোরা একটু বোস, আমি ভাতটাত নিয়ে আসি।
একটু পর খাবার-টাবার এসে গেল। টেবল চেয়ারে সাহেবি ব্যাপার কিন্তু খাওয়াটা একেবারে দিশি মতে। বড় বড় কঁসার থালা এবং বাটিতে ভাত-মাছ ডাল-তরকারি সাজিয়ে দিলেন তপতীর মা। একটা বেহারি ঠাকুর হাতের কাছে সব যুগিয়ে তাকে সাহায্য করতে লাগল।
সবাইকে খেতে দিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন তপতীর মা। কার পাত খালি হয়ে যাচ্ছে, কার কী দরকার, লক্ষ্য রাখতে লাগলেন।
সোমা খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে তপতীর মাকে দেখছিল। ইচ্ছা করে যে দেখছিল তা নয়, তপতীর মা দুরন্ত আকর্ষণে যেন তার চোখ দুটিকে নিজের দিকে টেনে রাখছিলেন।
তপতীর মা হয়তো লক্ষ্য করেছিলেন। বললেন, আমায় কিছু বলবে সোমা?
না মাসিমা–সোমা মাথা নাড়ল, আমি আপনাকে দেখছি।
আমাকে দেখছ! তপতীর মা অবাক।
হ্যাঁ, আপনার মতন সুন্দর মানুষ আমি আর কখনও দেখিনি মাসিমা।
তপতীর মা লজ্জা পেয়ে গেলেন, তার কান আরক্ত হল, কী যে বলো!
তপতী ওধার থেকে বলে উঠল, জানিস সোমা, আমরা কেউ মার সঙ্গে কখনো রাস্তায় বেরুই না।
সোমা বিমুড়ের মতন জিগ্যেস করল, কেন?
লোকে বিশ্বাসই করতে চায় না আমরা এই মায়ের ছেলেমেয়ে। সবাই ভাবে সুন্দর বউটা কোত্থেকে কাকের ছানা বকের ছানা জোটাল।
দোলন চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিল। ফস করে বলল, সেবার নতুন এসপি. সাহেবের স্ত্রী আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। দিদি কলকাতায় ছিল, দাদা পাটনায়। আমাকে আর ঝুলনকে দেখিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, এরা কারা? মা বলল আমার মেয়ে। ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন, তোমার নিজের ছেলেমেয়ে, না সতীনের?
তপতীর মা বিব্রত মুখে বললেন, মেয়েদের কথা শোনো!
দোলন বলল, মেয়েরা ঠিক কথাই তো বলছে
তপতীর মা বললেন, কী ভালো লাগছে রে?
এই যে সবাই মিলে তোমার রূপের এত প্রশন্তি গাইছে। দেমাকে নিশ্চয়ই খুব ফুলে যাচ্ছ।
ধমক দিতে গিয়ে হেসে ফেললেন তপতীর মা, চুপ কর হনুমান
সোমার মনে হল, ভদ্রমহিলা রাগ করতে জানেন না।
একটু নীরবতা। তারপর তপতীর মা সোমাকে বললেন, বাঁদরগুলো সমানে জ্বালাচ্ছে। তোমার সঙ্গে কথাই বলতে পারছি না মা। তপীর চিঠিতে জেনেছি তোমরা লক্ষ্ণৌতে থাকো। কদ্দিন আছ ওখানে?
সোমা বলল, অনেকদিন। প্রায় দু-পুরুষের মতন। আমার ঠাকুরদা তার পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে ওখানে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেই থেকেই আছি।
ওখানে বাড়ি-টাড়ি করেছ?
হ্যাঁ।
বাবা-মা?
আছেন।
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সোমাদের বাড়ির অনেক খবর নিলেন তপতীর মা। তারপর বললেন, তোমারা কভাইবোন?
দুই ভাই, দুই বোন। আমি সবার ছোট।
অন্য ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
ওধার থেকে তপতী বলল, সোমার বিয়ের জন্যেও তো লক্ষ্ণৌ থেকে ওর বাবা-মা তাড়া দিচ্ছেন। ও কিছুতেই বিয়ে করতে চায় না।
তপতীর মা বললেন, তা তো দেবেনই। মেয়ে যত লেখাপড়াই শিখুক আর যা-ই করুক, বিয়ে দিতে না পারলে কোনও বাপ মা-ই নিশ্চিন্ত হতে পারে না। তারপর সোমাকে বললেন, তোমার বাবা-মা তো বললে বেশ অসুস্থ
হ্যাঁ-আবছা গলায় সোমা উত্তর দিল।
বিয়েটা করে ফেলো মা। যে বয়সের যা, জীবনে ওটা প্রয়োজন।
সোমা চুপ করে রইল। শুধু দুর থেকে মৃন্ময় লক্ষ্য করল, মুখটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গেছে সোমার। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। সে অনুমানও করতে পারল না, এই মুহূর্তে সোমার রক্ত মাংসে কী দারুণ যুদ্ধ চলছে।
হঠাৎ মৃন্ময় বলল, তুমি কী ফুলমাসি!
কেন, কী! মৃন্ময়ের বলার ধরনে তপতীর মা চমকে উঠলেন।
নিজেরা তো বিয়ে-টিয়ে করে ল্যাজ কেটে বসে আছ। আবার অন্যের ল্যাজও কাটাতে চাইছ। কেন বাপু, আজাদি চিড়িয়া আকাশে উড়ছে, তাকে উড়তেই দাও না