তপতী ভাইবোনদের সঙ্গে সোমার আলাপ করিয়ে দিল। কিশোরী দুটির মধ্যে যে বড় তার নাম দোলন, ছোটটির নাম ঝুলন। ছেলেটি তপতীর একমাত্র ভাই; ডাকনাম পিন্টু। ওরা সোমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। সোমা বিব্রত মুখে বলল, থাক থাক, আজকাল আবার কেউ পায়ে হাত দেয় নাকি
পিন্টু চমৎকার ছেলে। বলল, বা রে, আপনি আমাদের দিদি না?
সোমার খুব ভালো লাগল ছেলেটাকে। স্নিগ্ধ হেসে বলল, তুমি কী করো, পড়ছ?
হ্যাঁ। মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, এটা আমার এম.বি.বি.এস. ফাইনাল ইয়ার।
তপতী বলল, বা রে তোরা সোমাকে প্রণাম করলি। আমাকে করবি না?
পিন্টু বলল, তোর প্রণামটা জমা থাক ছোটদি। ইয়ার এন্ডিং-এ সব একসঙ্গে চুকিয়ে দেব। দোলন-ঝুলন বলল, আমরাও—-
ভাইয়ের মাথায় স্নেহভরে আলতো করে একটা চটি কষিয়ে দিল তপতী, মহা ওস্তাদ হয়ে উঠেছিস।
সোমা অবাক, ব্যাপার কী রে, এক সঙ্গে প্রণাম চুকিয়ে দেবে মানে?
তপতী হেসে ফেলল, ওরা আমাকে এমনিতে প্রণাম করে না। সারা বছরের প্রণাম জমিয়ে রাখে, তারপর বছরের শেষে পাওনা চুকিয়ে দেয়।
সোমা রগড়ের গলায় বলল, সারা বছরে তোর কটা প্রণাম পাওনা হয় রে?
একটু ভেবে নিয়ে তপতী বলতে লাগল, নববর্ষে একটা, বিজয়ায় একটা, আমার জন্মদিনে–একটা হ্যাঁ, আট-দশটা তো হয়ই।
আট-দশটা প্রণাম ওরা একসঙ্গে করে?
তপতী মাথা হেলিয়ে দিল, হুঁ—-
সোমা হেসে ফেলল, বাবা, অফিসের ছুটির মতন প্রণামও যে জমানো যায়, আমার ধারণা ছিল না।
পিছন থেকে আচমকা মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ গল্প করবি তপী? আমার হাত কিন্তু ছিঁড়ে যাচ্ছে।
পিন্টু ছুটে গিয়ে মৃন্ময়ের হাত থেকে একটা সুটকেশ আর হোল্ডলটা নিয়ে তাকে খানিকটা হালকা করল।
তপতী বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চল, ভেতরে যাই। সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
সোমাও তপতীর দুই বোনের কাঁধে হাত রেখে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। দুজনের মধ্যে দোলন বড়, ঝুলন ছোট। সোমা দোলনকে বলল, তুমি কী পড়ো?
ক্লাস টেনে।
হিউম্যানিটিজ গ্রুপ?
না, সায়েন্স।
অঙ্কে তা হলে তোমার দারুণ মাথা
দোলন লজ্জা পেয়ে মুখ নামাল।
সোমা এবার ঝুলনকে বলল, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
ঝুলন বলল, নাইনে
তুমিও সায়েন্স গ্রুপের?
না, হিউম্যানিটিজ। ছোটদির মতন অঙ্ক-টঙ্ক আমার মাথায় ঢোকে না।
গল্প করতে করতে ওরা থামওলা বিরাট বারান্দায় উঠে এল। আর তখনই বাড়ির ভেতর থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারল না সোমা। মনে হল, তিনি আসাতে দুপুরের সূর্যালোক যেন আরো অনেকখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
বয়স কত হবে? পঁয়তাল্লিশের বেশি কখনওই না; দেখায় কিন্তু তিরিশ পঁয়তিরিশের মতন। গায়ের রঙ যেন শরতের রৌদ্রঝলক। নাক-মুখ-চোখ সব মিলিয়ে তিনি রূপের প্রতিমা। হাতভর্তি গোছা গোছা সোনার চুড়ি তার গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে আছে। গলায় পুরনো আমলের তেঁতুলপাতা হার; নিটোল আঙুলে লাল পাথর বসানো আংটি। পরনে নকশা করা চওড়াপাড় ধবধবে শাড়ি আর গরদের ব্লাউজ। কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ।
তপতী বলল, আমার মা–
সোমা প্রণাম করবার জন্য ঝুঁকল কিন্তু পা ছোঁবার আগেই তপতীর মা তাকে বুকে তুলে নিলেন। সস্নেহ কোমল গলায় বললেন, তুমিই সোমা! এসো মা এসো–সবাইকে নিয়ে ভেতরে যেতে যেতে তিনি আবার বললেন, তোমাকে কিন্তু আরো আগেই আশা করেছিলাম মা। গেল বছর নভেম্বর মাসে তপী লিখেছিল, তোমাকে নিয়ে আসবে, আমরা পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর প্রতি মাসেই ও লিখে যাচ্ছে, তুমি আসছ! তারও এতদিন পর এলে।
তপতী বলল, কত সাধ্যসাধনা করে ওকে আনতে হয়েছে তা তো জানো না মা। কলকাতা থেকে নড়তেই চায় না। কলেজের ক্লাস আর হোস্টেলে নিজের ঘর, এর মধ্যেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়ে দিচ্ছে।
আধফোটা জড়ানো গলায় সোমা কিছু একটা বলল, বোঝা গেল না।
তপতীর মা বললেন, তপী লিখেছিল, তোমরা লক্ষ্ণৌয়ে থাকো?
আজ্ঞে হ্যাঁ
সেখানে যাও না?
যাই মাঝে মধ্যে।
তপতী বলে উঠল, মাঝে মধ্যে না হাতি। জানো মা, আড়াই বছরে সোমা মোটে একবার লক্ষ্ণৌতে গেছে।
সোমা বলল, একবার গেছি। তোকে বলেছে। তাকে অত্যন্ত বিব্রত এবং চঞ্চল দেখাল। তপতীর মা এ সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না।
কথায় কথায় ওরা বাড়ির ভেতর চলে এসেছিল। মাঝখানে প্রকাণ্ড বাঁধানো উঠোনের চারধারে বড় বড় খোলামেলা ঘর। তপতীর মা ওদের নিয়ে দক্ষিণ দিকের একটা ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
জানালার ধার ঘেঁষে পুরোনো আমলের নকশা-করা ভারী খাট পাতা। তার ওপর ধবধবে বিছানা। আরেক ধারে ফুল লতাপাতা-আঁকা আলমারি, ড্রেসিং টেবল, খান দুই সোফা, মাথার ওপর দুই ফলা-ওলা ফ্যান।
তপতীর মা বললেন, এটা তোমাদের ঘর। যে কদিন আছ, তোমরা দুই বন্ধু এ ঘরে থাকবে।
এক পলক চারদিক দেখে নিল সোমা। ঘরটা বেশ নিরিবিলি; তার খুব পছন্দ হয়ে গেল।
তপতীর মা আবার বললেন, একটু বিশ্রাম-টিশ্রাম করে স্নান করে নাও। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমোও। নিশ্চয়ই কাল ট্রেনে ঘুম হয়নি।
তপতী বলল, আমি ঘুমিয়েছি। তবে সোমাটা ঘুমোয়নি; ওর ভীষণ ইনসমনিয়ার ধাত। ঘুমের বড়ি খেলে ঘুম আসে না।
তপতীর মা কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থাকলেন। ক্রমশ তার কপাল কুঁচকে যেতে লাগল। এক সময় বললেন, এ তো ভালো কথা না মা; কী এমন বয়স তোমার। এর মধ্যেই যদি ঘুমের বড়ি খেতে হয়-না না, তুমি ভালো ডাক্তার দেখাবে, বুঝলে?