তপতী মৃন্ময়ের কাণ্ড দেখে খুব হাসছিল। হাসতে হাসতেই সোমার কাঁধে আঙুলের খোঁচা দিয়ে বলল, দ্যাখ, মৃন্ময়দাটা এক্কেবারে যাচ্ছেতাই
ওই রকম একটা বাজে লোকের কুরুচিকর কোমর-নাচানি দেখে এত হাসবার কী আছে সোমা ভেবে পেল না। সে উত্তর দিল না।
আবার কী বলতে গিয়ে হঠাৎ সোমার দিকে তাকাল তপতী, সঙ্গে সঙ্গে তার হাসি থেমে গেল। সোমার মুখ লাল, চোয়াল শক্ত। কিছু একটা আন্দাজ করে সে মৃন্ময়ের দিকে তাকাল। ধমকের গলায় বলল, কী হচ্ছে মৃন্ময়দা!
মৃন্ময় হকচকিয়ে গেল, আরে ছোঁড়াটার টুইস্ট ঠিক হচ্ছে না, তাই একটু দেখিয়ে দিচ্ছি।
কড়া গলায় তপতী বলল, চুপ করে বোসো তো
এক পলক তপতীকে দেখল মৃন্ময়, তারপর দেখল সোমাকে। দেখতে দেখতে বিমূঢ়ের মতন ঝুপ করে বসে পড়ল।
চাপা গলায় তপতী বলল, এক গাড়ি লোকের সামনে নাচতে তোমার লজ্জা করল না! ছি! বন্ধুর কাছে আমার আর মান-ইজ্জৎ রইল না।
মৃন্ময় বলতে চেষ্টা করল, না মানে তপতী চেঁচিয়ে উঠল, চুপ করো–তারপর সোমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করল, কিছু মনে করিস না ভাই। মৃন্ময়দার মাথায় ছিট-ফিট আছে।
সোমা এবারও চুপ করে থাকল।
গাইয়ে ছোকরাটা হয়তো বিপজ্জনক কিছুর আভাস পেয়েছিল। গান-টান থামিয়ে ভয়ে ভয়ে মৃন্ময়কে বলল, সাহাব, মেরা পাইসা।
নিঃশব্দে পকেট থেকে একটা টাকা বার করে দিতেই ছোকরাটা চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। তারপর সবাই চুপচাপ। সোমা, তপতী, মৃন্ময়–তিনজন অপরিচিতের মতন পাশাপাশি বসে থাকল।
আরো ঘণ্টাখানেক পর ঘাটগাড়ি কাটিহার জংশনে পৌঁছে গেল।
স্টেশনে নেমে মৃন্ময় তপতীকে বলল, এখান থেকে কীসে পূর্ণিয়া যাবি? ট্রেনে, না ট্যাক্সিতে?
তপতী বলল, ট্যাক্সিতে।
ট্রেনে গেলে কিন্তু জানিটা লাভলি লাগত,মৃন্ময় চোরা চোখে একবার সোমাকে দেখে নিল। সোমার মুখ এখনও থমথমে গম্ভীর। মৃন্ময়ের কথা সে শুনেছে বলে মনেই হল না।
তপতী বলল, না-না, এখন শোভা দেখতে দেখতে খাবার সময় নেই। সাড়ে বারোটা বাজে; দারুণ খিদে পেয়ে গেছে। তুমি চট করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসো মৃন্ময়দা
মার্চের সূর্য এখন সোজা মাথার ওপর। সকালের দিকে রীতিমতো শীত শীত করছিল, হিমে গায়ে কাটা দিচ্ছিল। আর এই দুপুরবেলা বাতাস তেতে উঠেছে, বেশ গরম লাগছে।
মৃন্ময় ট্যাক্সি নিয়ে এল। ওরা উঠতেই গাড়িটা এক সেকেন্ড আর দাঁড়াল না; সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট দিল।
তারপর দুমিনিটের মধ্যে কাটিহার জংশন পিছনে ফেলে ট্যাক্সিটা হুস করে যেখানে এসে পড়ল তার দুধারে সবুজ কার্পেটের মতন মাঠ, টুকরো টুকরো বিহারি গ্রাম, একটানা পানিফলের বিল আর মাঝে মাঝে অনেকখানি জায়গা জুড়ে আম বাগান। ছোট ছোট সবুজ গুটিতে আমগাছগুলো বোঝাই হয়ে আছে। আর দেখা যাচ্ছিল বেঁটে বেঁটে অষ্টবক্ৰ মুনির মতো এক ধরনের অদ্ভুত গাছ। এমন গাছ আগে আর কখনও দেখেনি সোমা।
এক জানালায় বসেছিল সোমা, আরেক জানালায় মৃন্ময়। মাঝখানে তপতী। হঠাৎ ওধার থেকে মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, মিস চ্যাটার্জী, ওই ট্যারা ব্যাকা গাছগুলো মার্ক করুন–
সোমা যেমন বাইরে তাকিয়ে ছিল তেমনই তাকিয়ে থাকল।
খুব উৎসাহের গলায় মৃন্ময় বলল, ওই গাছগুলোর নাম সীসম। এমন গাছ আপনি বাংলাদেশে দেখতে পাবেন না।
সোমা কোনওরকম কৌতূহল বা আগ্রহ দেখাল না।
ঝুঁকে বসে আবার কী বোঝাতে যাচ্ছিল মৃন্ময়, তপতী বিরক্ত সুরে বলল, তুমি কি একটুও মুখ বুজে থাকতে পারো না মৃন্ময়দা
ঝপ করে আলো নিভে গেলে যেমন হয়, মৃন্ময়ের মুখটা তেমনি মলিন হয়ে গেল। বিব্রতভাবে বলল সে, আচ্ছা বাপু থামছি, আর একটি কথাও বলব না।
কাটিহার থেকে পুরো এক ঘণ্টাও লাগল না, তার অনেক আগেই ওরা পুর্ণিয়ায় পৌঁছে গেল।
.
০৩.
পুর্ণিয়ার যে পাড়ায় তপতীদের বাড়ি তার নাম ভাট্টা। একেবারে দরজার ওপর ওদের নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিটা চলে গেল।
অনেকখানি জায়গা নিয়ে তপতীদের প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি। সামনের দিকে বিরাট ফুলের বাগান। ফুল বলতে শুধু গোলাপ। লাল, সাদা, ফিকে হলুদ– নানারঙের গোলাপে বাগান ছেয়ে আছে
আজকাল কোনও কিছুতেই মুগ্ধ হয় না সোমা; ফুটন্ত দুধের মতন টগবগে আবেগ তার খোয়া গেছে। তবু কয়েক পলক বাগানটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারল না সে। বলল, তোদের বাগানটা তত চমৎকার রে তপতী। এত গোলাপ, এত রকমের গোলাপ, আমি আর কখনও দেখিনি।
তপতী হাসল, পুর্ণিয়ার লোকেরা আমাদের বাড়িটাকে কী বলে জানিস?
কী?
গোলাপবাড়ি।
সার্থক নাম।
দুহাতে দুই সুটকেশ, বেতের বাক্সেট আর বগলে হোল্ডল নিয়ে সোমাদের ঠিক পিছনেই আসছিল মৃন্ময়। বাগানের মাঝখান থেকেই সে গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগল, ফুলমাসি আমরা এসে গেছি। দোলন-ঝুলন–পিন্টু, তোরা কোথায় রে? শিগগির বেরিয়ে আয়
তপতীদের পুরোনো আমলের দোতলায়। মোটা মোটা থাম, চওড়া চওড়া সিঁড়ি, গরাদহীন খড়খড়ি-ওলা বড় বড় জানলা, ঘুলঘুলিতে পায়রা–সব মিলিয়ে তার গায়ে উনিশ শতকের একটা গন্ধ যেন মাখানো।
তপতীরা সিঁড়ির কাছে আসবার আগেই দুটি কিশোরী আর একটি যুবক বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। মেয়ে দুটির বয়স চোদ্দ থেকে ষোলর মধ্যে। এখনও শাড়ি-টাড়ি ধরেনি। যুবকটির বয়স কুড়ি একুশের মতন। তিনজনেরই চোখে মুখে তপতীর আদল বসানো। এক পলক দেখেই টের পাওয়া যায়, ওরা তপতীর ভাইবোন।