তপীর হাওয়া আপনারও গায়ে লেগেছে দেখছি। আর সাধাসাধি না করে বাকি নিমকি-টিমকিগুলো চোখের পলকে শেষ করে ফেলল মৃন্ময়।
.
সাড়ে দশটায় ট্রেন ছাড়ল। ওরা তিনজনেই জানালার ধারে বসে ছিল। বাইরে আদিগন্ত সবুজ মাঠ। ঝোপঝাড়, গাছপালা, মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো রবিফসলের খেত। রুপোলি ঝলকের মতন হঠাৎ একেকটা নদী কিংবা খাল দেখা দিয়েই অদৃশ্য হচ্ছে। কোথাও মোষের পাল চলেছে, তাদের পিঠে ছোট্ট দেহাতি ছেলে অবাক বিস্ময়ে ট্রেন দেখছে। অনেক উঁচুতে পালিশ করা আয়নার মতন ঝকঝকে নীলাকাশ। ট্রেন বাঁক নেওয়াতে সাঁওতাল পরগণার রেঞ্জটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
তপতী বলল, কী বিউটিফুল মাঠ দেখেছিস সোমা।
সোমার ভালো লাগছিল; আকাশ-মাঠ দেখতে দেখতে মাথা নাড়ল সে।
ওধার থেকে মৃন্ময় বলে উঠল, মনেই হয় না আমরা বিহারে আছি; একজ্যাক্ট বাংলাদেশ যেন। একটু থেমে আবার বলল, তপীটা গান জানে না, আপনি জানেন, সোমাদেবী?
সোমা বলল, না।
সত্যিই কিছু জানেন না। বাথরুম সং-টংও কোনওদিন করেননি?
না।
আপনি একটা বোগাস।
সোমার মুখ-টুখ লাল হয়ে উঠল; মাথার ভেতরটা ঝা-ঝ করতে লাগল। মৃন্ময়ের সঙ্গে ভালো করে আলাপই হয়নি। সে যে দুম করে এ রকম একটা কথা বলতে পারে, সে ভাবতে পেরেছিল। রাগ, অপমান–সব মিলিয়ে যেন কেমন হয়ে গেল সোমা। ভারি ইতর তো লোকটা!
সোমার দিকে তাকালও না মৃন্ময়। হঠাৎ উচ্ছ্বাসে মোটা বেসুরো গলায় গেয়ে উঠল।
আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন, তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা ফাগুনে তোর—
তপতী দুকানে হাত চাপা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, থামো থামো; বেচারি রবীন্দ্রনাথকে অন্তত রেহাই দাও
মৃন্ময় গান থামিয়ে কাচুমাচু মুখে বলল, কেন রে, গানটা ভালো লাগছে না?
গানটা খারাপ কে বলেছে? বাংলা ভাষায় এরকম গান আর কটা লেখা হয়েছে! তবে
বুঝেছি, আমার গলাটা রাবিশ, এই তো? বলেই সোমার দিকে তাকাল, জানেন মিস চ্যাটার্জি, গলায় আমার একদম কনট্রোল নেই। হাঁ করলে একসঙ্গে আঠারো রকমের আওয়াজ বেরিয়ে আসে। সবই জানি, তবু আবেগ উথলে উঠলে নিজেকে আর সামলাতে পারি না। বলতে বলতে হেসে ফেলল মৃন্ময়। সোমা তাকিয়েই ছিল। এমন সরল নিষ্পাপ ছেলেমানুষির হাসি সে খুব বেশি দেখেনি। আশ্চর্য, একটু আগে মৃন্ময়কে মনে হয়েছিল ইতর।
তপতী হঠাৎ বলল, ও গানটা তোমার গাওয়া উচিত না মৃন্ময়টা
মৃন্ময় অবাক, কেন রে?
তুমি বিহারে বর্ন অ্যান্ড ব্রট-আপ। বাংলাদেশ নিয়ে মাতামাতি করার রাইট নেই তোমার। তোমার গাওয়া উচিত, আমার সোনার বিহার, আমি তোমায় ভালোবাসি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মৃন্ময়। তারপর গাঢ় গলায় বলল, যেখানেই জন্মাই আর যেখানেই থাকি, এই বুকের ভেতরটায় যা আছে তার নাম বাংলাদেশ।
চোখ বড় বড় করে কৌতুকের গলায় তপতী বলল, এ যে দেখছি রামভক্ত হনুমানের মতন; বুক চিরে বাংলাদেশ দেখাবে নাকি?
ইচ্ছে করলে তা পারি রে–
মাঠের মাঝখানে একেকটা স্টেশন আসে। কিছু দেহাতি লোক মালপত্র আঁকা-টাকা নিয়ে হুড়মুড় করে ওঠে, কিছু নামে। তারপরই ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠে। ট্রেনটা ছুটতে থাকে।
একটা স্টেশন থেকে এক গাইয়ে ছোকরা উঠল। তেরো-চোদ্দর মতন বয়স। আঁকড়া চুল ধুলো-বালিতে জট পাকিয়ে আছে। পরনের ইজেরটা তেলে-ময়লায় চিটচিটে, খালি গা। দুহাতে দুটকরো কাঠ। সে দুটো বাজিয়ে মিষ্টি গলায় সে গেয়ে উঠল, পাতলী কোমরি হায়, তিরছি নজরী হায়—
মৃন্ময় কষে ধমক লাগল, থাম ব্যাটা—
ছেলেটা ভয় পেয়ে গেল, জি
পন্দর সাল আগের মাল এখনও চালিয়ে যাচ্ছিস ব্যাটা। নয়া গানা লাগা।
নয়া গানামে জ্যাদা পাইসা লাগেগা বাবুজি
চোখ গোল করে মৃন্ময় বলল, ও বাবা, এ যে দেখছি কড়া জিনিস। ঠিক হায়, জ্যাদা পাইসাই পাবি।
বহুত খুব—বলেই গলা চড়িয়ে গান ধরল, রূপ তেরা মস্তানা, পেয়ার মেরে দিওয়ানা সেই সঙ্গে কাঠের টুকরোর বাজনা-টক-টক্টররেট
বহুত আচ্ছা বহুত আচ্ছা—মাথা নেড়ে নেড়ে তাল দিতে লাগল মৃন্ময়।
গান চলছিলই। হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে মৃন্ময় বলল, এ ছোঁকরে, গানাকা সথ নাচা ভি তো লাগাও–
গান থামিয়ে ছেলেটা বলল, জি–
আরে বাবা, নাচা-গানা একসাথ। ছেলেটাকে উৎসাহ দেবার জন্য তুড়ি দিয়ে দিয়ে মৃন্ময় কাধ নাচাতে লাগল।
ছেলেটা এবার বুঝতে পারল। বলল, কোন্ সা নাচা সাহাব?
টুইস্ট জানিস,
জি-রাজেশ খান্নাকা তরা?
রাজেশ খান্নাকেও জানিস নাকি!
জরুর; উও তো বঢ়িয়া বাহাদুর
লাগা তাহলে রাজেশ খান্নার মতন
ছেলেটা পা কাঁপয়ে কাঁপয়ে গানের সঙ্গে নাচাও জুড়ে দিল। ঘাড় কাত করে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল মৃন্ময়; তারপর চেঁচিয়ে উঠল, ধুর-টুইস্ট-ফুইস্ট তুই কিছু জানিস না। আমার কাছে শিখে নে। কোমর এবং হাঁটু কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে এক পাক নেচে দেখিয়ে দিল মৃন্ময়।
সোমা অবাক চোখে মৃন্ময়কে দেখছিল। কিছুক্ষণ আগে এই মানুষটাকে সরল নিষ্পাপ বালকের মতন মনে হয়েছিল। আর এখন? মনে হচ্ছে তপতীর এই মাসতুতো ভাইটা ক্লাউন ছাড়া আর কিছু না। কোনও ভদ্র রুচির মানুষ যে এভাবে নাচতে পারে, সোমা কল্পনাই করতে পারে না। বিরক্তি রাগ আর অস্বস্তিতে তার চোখমুখ কুঁচকে যেতে লাগল।
গাইয়ে ছোকরাটা আবার নতুন করে শুরু করল। কিন্তু কিছুতেই আর মৃন্ময়ের পছন্দমতো হচ্ছে না; বারবার ভুল শুধরে দিতে লাগল মৃন্ময়।