মৃন্ময়ের সঙ্গে তপতীকে কথা বলতে দেখে সোমা কুলিটাকে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তপতী তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এল, এই যে আমার বন্ধু–সোমা চট্টোপাধ্যায়। তারপর সোমাকে বলল, আর ইনি আমার পূজ্যপাদ মাসতুতো ভাই শ্রীমান মৃন্ময় মিত্র, দিল্লির একটা ফার্মে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট। আমার চাইতে পাক্কা তিন বছরের ছোট। তবে দাদা শুনবার খুব শখ কিনা, তাই মৃন্ময়দা বলি।
ইয়ার্কি হচ্ছে! মৃন্ময় চড় তুলল, তপতী চট করে মাথাটা সরিয়ে খুব হাসতে লাগল। মৃন্ময়ও হেসে ফেলল, তারপর সোমার দিকে ফিরে বলল, আপনার এই বন্ধুটি মহা ধনুর্ধর।
মুখ নীচু করে সোমা হাসল।
মৃন্ময় আবার বলল, তপতীর মতন আপনিও কলেজে পড়ান নাকি?
হাঁ–আস্তে করে মাথা নাড়ল সোমা।
আপনার কী সাবজেক্ট?
হিস্ট্রি
বেশ পণ্ডিত লোক দেখছি
মৃদু স্বরে সোমা বলল, কলেজে পড়ালেই পণ্ডিত হয়ে যায় নাকি?
মৃন্ময় বলল, অত শত জানি না। তবে প্রফেসার-ট্রফেসার দেখলে আমার ভীষণ ভক্তি হয়। ইচ্ছে করে পায়ের ধুলো নিই। মাঝে মাঝে তপীর পায়ের ধুলোও নিয়ে থাকি।
ওধার থেকে তপতী ভেংচে উঠল, এ-হে-হে-হে
বিব্রতভাবে সোমা বলল, কী যে বলেন।
সোমার কথা যেন শুনতেই পেল না মৃন্ময়। দ্রুত চারদিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে খুব নীচু গলায় বলল, ব্যাপারটা কী জানেন?
কী?
নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে মৃন্ময় বলল, এই যে মহাপুরুষটিকে দেখছেন ম্যাট্রিকের বেড়া ডিঙোতে এঁর সাতটি বছর লেগেছিল। তারপর আর কলেজে যেতে সাহস হয়নি। তাই কেউ এম.এ পাশ করে প্রফেসারি করছে শুনলে মনে হয় তার গোলাম হয়ে থাকি।
ভদ্রলোক ঠাট্টা করছে কিনা সোমা বুঝতে পারল না। সে চুপ করে রইল।
এদিকে লটবহর মাথায় কুলিটা দাঁড়িয়ে থেকে থেকে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, আউর কিতনা টিম (টাইম) খড়া রহেগা
তপতী তাড়া লাগাল, চল চল, সব কথা এখনই ফুরিয়ে ফেললে পরে বলবে কী? বলে চোখ টিপল।
মৃন্ময় লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ চল
ওপারের মতন মনিহারি ঘাটেও মাঠের মাঝখানে রেলস্টেশন। স্টেশন আর কী, অস্থায়ী কটা চালাঘর। তারপর দরমা আর টিনের ছাউনিতে কিছু দোকানপাট চায়ের দোকান, পানবিড়ির দোকান, সস্তা, খাবার-দাবারের দোকান এবং কটা ছোটখাটো হোটেল। সেখানে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল।
মৃন্ময় একটা কামরায় গিয়ে উঠল। তারপর সুটকেশ-টুটকেশ গুছিয়ে অঢেল জায়গা নিয়ে সবাই বসল। পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরাল মৃন্ময়। লম্বা একটা টান নিয়ে ফুক ফুক করে ধোঁয়ার আংটি ছাড়তে লাগল।
হঠাৎ কী মনে পড়তে তপতী মৃন্ময়কে বলল, ওই দ্যাখ, সেই কথাটা জিগ্যেস করতে এক্কেবারে ভুলে গিয়েছি। তুমি দিল্লি থেকে কবে পূর্ণিয়ায় এসেছ?
পরশু। তোর মা জরুরি তলব পাঠিয়েছে যে
কী ব্যাপার?
দুই হাত চিত করে কঁধ ঝাঁকাল মৃন্ময়, কী জানি, এখনও ফুলমাসি (তপতীর মা) কিছু বলেনি! ঝুলি থেকে বেড়াল-টেড়াল একটা কিছু বেরুবেই। তার জন্য অপেক্ষা করছি।
একটু ভেবে তপতী বলল, এবার কিন্তু অনেকদিন পর পুর্ণিয়ায় এসেছ।
হ্যাঁ-মনে মনে হিসেব করে মৃন্ময় বলল, দেড় বছর পর এলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর মৃন্ময়ের কী যেন মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ রে তপী, সাহেবগঞ্জে তোরা কখন পৌঁছেছিস?
ভোরবেলা
কিছু খেয়েছিস?
এক ভাঁড় করে চা শুধু
সে কী রে–মৃন্ময় উঠে পড়ল, বাড়ি যেতে যেতে দুটো আড়াইটে হয়ে যাবে। ততক্ষণ না খেয়ে কি থাকা যায়; সঙ্গে একজন গেস্ট আছেন।
বিব্রত মুখে সোমা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমার জন্যে ব্যস্ত হবেন না–
তাই কখনো হয়। মৃন্ময় বলল, এখানে হোটেল রয়েছে। চল, চট করে তিনজনে খেয়ে আসি। ট্রেন ছাড়তে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি আছে।
শক খাবার মতন চেঁচিয়ে উঠল তপতী, ওরে বাবা, রক্ষা করো।
কী হল রে? মৃন্ময় অবাক।
এ সব হোটেলে খেতে-টেতে পারব না। মাটিতে বসে খাওয়া, তার ওপর ভাত-তরকারিতে কিচকিচে বালি, রাঁধুনে ঠাকুর-টাকুরগুলো সাত জন্মে কাপড়-চোপড় কাঁচে না বড় বড় নখ আর ফাটা ফাটা হাতের ভেতর ময়লা–ন্যাস্টি! তপতীর নাক-মুখ কুঁচকে যেতে লাগল।
তোর তো আবার পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোঁরায় খাবার অভ্যাস। কিন্তু মনিহারি ঘাটের এই বেলেমাটির চড়ায় কলকাতার পার্ক স্ট্রিট কোথায় পাই। তুই ট্রেনেই বসে থাক, আমি সোমাদেবীকে খাইয়ে আনি।
আমার চাইতে সোমা অনেক বেশি খুঁতখুঁতে। মেরে ফেললেও ওকে তুমি ওই হোটেলে ঢোকাতে পারবে না।
তাহলে আর কী করব! মৃন্ময়কে হতাশ দেখাল। পরক্ষণেই কী ভেবে খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল সে, এক কাজ করি বরং
তপতী বলল, কী?
ট্রেনের টাইমে এখানে সিঙাড়া নিমকি ভাজে। গরম গরম কটা নিয়ে আসি।
তুমি ক্ষেপেছ মৃন্ময়–পচা তেল-ফেল দিয়ে ভাজে ওই সব। খেলে আর দেখতে হবে না; হাতে হাতে একখানা গ্যাসট্রিক আলসার
ভুরু কুঁচকে ধমকে উঠল মৃন্ময়, অত খুঁতখুঁতনি কীসের রে? এই বয়সে যা পাবি তা-ই খাবি, চব্বিশ বছর না পেরুতেই বুড়ো-বুড়িদের মতন কতাবার্তা।
মৃন্ময় গাড়ি থেকে নেমে গুচ্ছের নিমকি-টিমকি নিয়ে এল।
কিছুক্ষণ নাকের ভেতর খুঁতখুঁত আওয়াজ করে নিতান্ত অনিচ্ছায় একটা সিঙাড়া তুলে নিল তপতী; সোমা নিল একটা নিমকি।
মৃন্ময় সোমাকে বলল, আর দু-একটা নিন-
সোমা বলল, না, না, আর লাগবে না।