সোমা বলল, হ্যাঁ, চরটা সত্যি সুন্দর রে–
দিন দিন এটা বড় হচ্ছে। দশ বছর আগে কতটুকু ছিল; আমার মনে হয় চরটা বড় হয়ে হয়ে একদিন নদীটাকেই বুজিয়ে ফেলবে।
সোমা চুপ। তপতী আবার বলল, আমার অনেকদিনের একটা ইচ্ছা আছে। কী?
ওই চরটায় একটা ঘর তুলে কিছুদিন থাকব। চমৎকার লাগবে না কী বলিস? নির্জন চরে, হু-হুঁ বাতাসে, চাঁদের আলোয় যা একখানা ব্যাপার হবে না? তুই থাকবি আমার সঙ্গে?
সোমা হেসে ফেলল, আমাকে কেন তোকে সঙ্গে নেবার লোক তো গোকুলে বাড়ছে। বিয়ের পর হনিমুনটা এই চরেই করিস।
তপতীর বিয়ে একরকম ঠিক হয়েই আছে। ছেলেটি আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চ স্কলার; মাস ছয়েকের ভেতর মেটালর্জিতে থিসিস সাবমিট করার কথা তার। ডক্টরেটটা পেয়ে গেলেই দেশে ফিরে বিয়েটা সেরে ফেলবে। ভালো চাকরি-বাকরি পেলে ইন্ডিয়ায় থেকে যাবে, নইলে বউ নিয়ে আবার আমেরিকায় পাড়ি।
হনিমুনের কথায় মুখ লাল হয়ে উঠল তপতীর। একটুক্ষণ চুপ করে থাকল সে। তারপর ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে চোখের কোণে তাকিয়ে বলল, হনিমুনের সময় তোকেও নিয়ে আসব।
অনেক অনেকদিন পর প্রগলভতার ঈশ্বর যেন সোমার কাঁধে ভর করল। সকালবেলার আকাশ নদী, টলটলে রোদ, সাঁওতাল পরগণার জাদুকর পাহাড়, সব একাকার হয়ে পাষাণভারের মতন তার বিষাদ ভুলিয়ে দিতে লাগল। তপতীর গলায় তর্জনীর আলতো ঠেলা দিয়ে রগড়ের গলায় সে বলল, দুজনেই মজা; তার মধ্যে আরেকজন ঢুকলেই গোলমাল। জানিস, আমাদের লক্ষ্ণৌতে একটা প্রবাদ আছে।
কী?
কাবাবমে হাড্ডি। শুধু শুধু আমাকে জুটিয়ে কেন কাবাবে হাড় ঢোকাতে চাইছিস ভাই?
দারুণ বলেছিস সোমা-শব্দ করে হেসে উঠল তপতী।
স্টিমারটা প্রকাণ্ড চাকায় জল কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছিল। নদীর ওপারটা দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে। ডেকের ওপর যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছিল, কেউ কেউ রেলিঙে ভর দিয়ে জলের উপর ঝুঁকে আছে। বেশির ভাগই স্থানীয় দেহাতি মানুষ, কিছু কিছু আদিবাসী সাঁওতালও চোখে পড়ছে। চোখে গগলস, পরনে চাপা প্যান্ট, কাঁধে ক্যামেরা, হাতে ট্রানজিস্টর-দুচারটে ছোকরাও ডেকের এ-মাথায় সে-মাথায় ঘোরাঘুরি করছে।
ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে সোমা বলল, আজ কতারিখ রে?
আট, কেন?
ফোরটিন্থ কিন্তু পূর্ণিয়া থেকে ফিরে আসব।
আরে বাবা এখনও পূণিয়ায় পৌঁছুলিই না। আগে চল, দুচারদিন থাক, তারপর তো ফেরার কথা।
না ভাই, ফোরটিন্থ ফিরতেই হবে। সেই কথা বলেই তুই এনেছিস। পরে ঝাট করবি না কিন্তু
আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবে। তপতী ব্যাপারটাকে আমলই দিল না।
সোমা বলল, দেখা যাবে বললে চলবে না। যদি আটকাতে চাস, এখনই বলে ফ্যাল। আমি এখান থেকেই ফিরে যাই।
কলকাতায় এখন তোর কোন রাজকার্য যে ফোরটিন্থ না ফিরলেই নয়? কমাসের ছুটি তো পড়ে পড়ে পচছে। আমাদের বাড়ি কদিন বেশি থাকলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
সে তুই বুঝবি না।
রাগ এবং অভিমানের গলায় তপতী বলল, বেশ বাবা, চোদ্দো তারিখেই আসিস। হল তত? ভেবেছিলাম তোকে নিয়ে কত জায়গায় যাব, কত কী দেখাব
সোমা উত্তর দিল না।
একটু পর স্টিমারটা মনিহারিঘাট পৌঁছে গেল।
.
০২.
খুব ভিড়-টিড় ছিল না; তাই হুড়োহুড়ি ছোটাছুটিও নেই। ধীরে ধীরে যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে। রিস্টওয়াচ দেখে তপতী বলল, সাড়ে নটা বাজে। আরেকটু কষ্ট করতে হবে, তারপরেই বাড়ি।
সোমা হাসল, আরেকটু কেন, অনেকখানি কষ্ট করতে হলেও রাজি। একবার যখন কলকাতা থেকে বেরিয়েছি, তোদের বাড়ি না গিয়ে ছাড়ছি না।
কুলি ডেকে মালপত্তর তার জিম্মায় দিয়ে ওরা উঠে পড়ল। কাঠের গ্যাংওয়ে পেরিয়ে পাড়ে উঠেই থমকে গেল তপতী। স্টিমারঘাট থেকে ওপরে উঠলেই রেললাইন, লাইনের কাছে মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা উদ্বিগ্ন, কিছুটা চিন্তিত। তার চোখ স্টিমারের দিকে। কাউকে খুঁজছে হয়তো।
ঝকঝকে স্মার্ট চেহারা মৃন্ময়ের। বয়স পঁয়ত্রিশের মতন। গায়ের রঙ কালোও না, আর ফর্সাও না। দুয়ের মাঝামাঝি। নাক-মুখ-টুখ, আলাদা আলাদাভাবে দেখলে হয়তো হাজার গন্ডা খুত বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু সব মিলিয়ে ভারি আকর্ষণীয়। পরনে ঢোলা পাজামা আর খদ্দরের ধবধবে পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত গুটনো, হাতে দামি ঘড়ি; চোখে গগলস।
মৃন্ময়কে এই মনিহারি ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল। কিছুক্ষণ অবাক থেকে আচমকা চেঁচিয়ে উঠল তপতী, মৃন্ময়দা
মৃন্ময় চমকে উঠল। তারপর চোখ থেকে গগল্সটা খুলে হাসিমুখে এগিয়ে এল, আরে, তপী
মৃন্ময়ের কথা শেষ হবার আগেই তপতী বলল, তুমি এখানে কী করছ?
তোর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।
আমার জন্যে?
ইয়েস ম্যাডাম। ভেবেছিলাম তোক একটা সারপ্রাইজ দেব।
কিন্তু এখন তুমি এখানে এলে কী করে? কাল বিকেলে কাটিহার থেকে লাস্ট ট্রেন এখানে এসেছে। তারপর তো আর কোনও ট্রেন ছিল না।
কাল বিকেলের ট্রেনটাই ধরেছিলাম। মাঝখানে মনিহারিতে নেমে রাতটা এক বিহারি বন্ধুর বাড়ি কাটিয়েছি। আজ সকালে সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে ঘাটে চলে এলাম। মৃন্ময় হাসতে লাগল।
তপতী বলল, তোমার মাথায় ছিট-টিট আছে।
যা বলেছিস; বলেই মৃন্ময় ব্যস্ত হয়ে পড়ল, হ্যাঁ রে পী, মাসিমার কাছে শুনেছি, তোর কে এক বন্ধু আসবে। তাকে দেখছি না তো–