আরো কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, ঘাটগাড়িটা বোঝাই হয়ে গেছে। এত লোক কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কে জানে। কোত্থেকে একটা ইঞ্জিন এসে গাড়িটার গায়ে লেগে গেল। তারপর গার্ডের হুইসল বাজল, ফ্ল্যাগ নড়ল, ভাঙা গলায় একবার চেঁচিয়ে উঠে ঘাটগাড়ি হেলে দুলে চলতে শুরু করল।
মিনিট পনেরো যাবার পর সোমার চোখে পড়ল, দূরে সাদা কাগজের মতন একটা নদী পড়ে আছে। তপতী প্রায় লাফিয়ে উঠল, নদীটা দেখেছিস সোমা?
অনুচ্চ মৃদু স্বরে সোমা বলল, হ্যাঁ
কী নাইস!
সোমা উত্তর দিল না, পলকহীন নদীটাকে দেখতে লাগল।
তপতী আবার বলল, ওই নদীটা আমাদের পেরুতে হবে।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ওরা সগরিগলি ঘাটে এসে গেল। ঘাটগাড়িটা সাহেবগঞ্জ থেকে যাদের তুলে এনেছিল, হুড়মুড় করে দরজা খুলে তারা বেরিয়ে পড়ল।
স্টেশনটা ভারি মজার। তার একধারে বিশাল মাঠ; আরেক ধারে দুপা বালির ডাঙা ভাঙলেই স্টিমার ঘাট। জেটিতে একটা স্টিমার দাঁড়িয়ে আছে। তার মাস্তুলে একটা শঙ্খচিল ডানা মুড়ে বসে আছে।
একটা কুলি ডেকে মালপত্র তার মাথায় চাপিয়ে ধীরে সুস্থে সোমারা নামল। স্ট্রিমারটার দিকে যেতে যেতে তপতী বলল, ঘাট অনেকটা এগিয়ে এসেছে। নইলে আরো সময় লাগত।
সোমা বলল, ঘাট এগিয়ে এসেছে; সে আবার কী? পিছিয়েও যায় নাকি?
হ্যাঁ। এই তো পুজোর পর যখন এলাম তখন ঘাটটা ছিল দুমাইল দূরে।
এ রকম কেন হয়?
নদী পাড় ভাঙছে, তাই ঘাটটা কখনও এগোয় কখনো পিছোয়।
গল্প করতে করতে ওরা স্টিমারে এসে উঠল। ডেকের একধারে চাদর বিছিয়ে বসতে বলতে সোমা জিগ্যেস করল, নদীটা পেরুতে কতক্ষণ লাগবে?
তপতী বলল, ঘণ্টাখানেক তত নিশ্চয়ই।
সূর্যটা আরো অনেকখানি উঠে এসেছে। নদীর শান্ত স্থির জলে এখন রোদের ছড়াছড়ি। বাতাসে হিমের ভাবটা কেটে এসেছে। তবু বেশ শীত শীত করছে। ঝাঁকে ঝাকে বক নদীর জলে ছোঁ দিয়ে পড়ছিল, এবং সঙ্গে সঙ্গে লম্বা ঠোঁটে একেকটা শিকার গেঁথে উঠে আসছিল।
এক সময় স্টিমার ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে নদীর এপারটা দূরে সরে যেতে লাগল। দূরে সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ি রেঞ্জটা আবছা হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে আগে আর কখনও আসেনি সোমা। সাঁওতাল পরগনা তো অনেক দূরের রাস্তা, কলকাতার পুব দিকেই এই তার প্রথম আসা। কালই প্রথম সে শিয়ালদা স্টেশনে ঢুকেছে। শিয়ালদার পর থেকে যা কিছু, এতদিন সবই ছিল তার অচেনা, বইয়ে-পড়া কোনও রহস্যময় মহাদেশের মতন।
শিয়ালদা আসার দরকারই হয় না সোমার। ঠাকুরদার আমল থেকেই ওরা ইউপি-তে ডোমিসাইল্ড। ঠাকুরদা তার যৌবনে চাকরি নিয়ে লক্ষৌ গিয়েছিলেন, সেই থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ একরকম ছিন্ন।
ঠাকুরদা অবশ্য সারাজীবন ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে গেছেন, বাবা কিন্তু উত্তর প্রদেশকেই স্বদেশ বলে জানেন। চাকরিতে থাকতে থাকতেই, এই তো সেদিন জায়গাটায়গা কিনে লক্ষ্ণৌতে বাড়ি করলেন। মা অবশ্য মৃদু আপত্তি করেছিলেন, তার মতে বাড়ি-টাড়ি দেশে গিয়েই করা উচিত। দেশ বলতে বাংলাদেশ। বাবা বলেছিলেন, এতদিন পর দেশে ফেরার মানে হয় না। বাংলাদেশটা তার মাতৃভূমি; এই পর্যন্ত। কিন্তু তার কতটুকুই বা তিনি চেনেন। সেখানকার গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন–সবই তার অজানা। এ বয়সে বাংলাদেশে ফিরলে অচেনা বিদেশির মতন থাকতে হবে।
বছর তিনেক হল বাবা রিটায়ার করেছেন, এখন লক্ষ্ণৌতে তার শান্ত অবসরের জীবন। দুই দাদা ওখানেই স্টেট গভর্নমেন্টে বিরাট চাকরি করে, মোটা মাইনে। একমাত্র দিদির বিয়ে হয়েছে কানপুরে; জামাইবাবু অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির অফিসার। তাদের সংসারে মোটামুটি সুখের।
ভাইবোনদের মধ্যে সোমাই ছোট। ছোট বলেই কিনা কে জানে, কিছুটা জেদি, এবং একগুঁয়ে। লক্ষ্ণৌ থেকে বিএ পাশ করার পর হঠাৎ সে ঠিক করে ফেলল কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে এমএ পড়বে। দাদারা বাধা দিয়েছিল। কলকাতায় আগে আর কখনও আসেনি সোমা। এই অচেনা শহরে কোথায় গিয়ে থাকবে সোমা, কোনও বিপদ-টিপদ হবে কিনা, এই সব ভেবেই দাদাদের আপত্তি। বড়দা বলেছিল, বিএ পর্যন্ত যখন এখানে পড়েছিস, এম.এ-টাও পড়ে ফেল। ছোটদা তার চাইতে মোটে দুবছরের বড়, দুজনের সম্পর্কটা নিয়ত যুদ্ধের। একজন আরেকজনের পেছনে দিনরাত লেগেই আছে। অবশ্য এই লাগালাগিটা পরস্পরের প্রতি টানেরই ছদ্মবেশ। ছোটদা বলেছিল, পড়িয়ে-টড়িয়ে আর দরকার নেই। বিয়ে দিয়ে ওটাকে পার করে দেওয়াই ভালো। তক্ষুনি দুজনের যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাবা তাদের থামিয়ে বলেছিলেন, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির সে গ্ল্যামার আর নেই, তুই বাপু এখানেই পড়। কিন্তু সোমা ঘাড় বাঁকিয়েই রেখেছিল, কলকাতায় সে পড়বেই।
শেষ পর্যন্ত সোমার জেদেরই জয় হয়েছিল। বাবা নিজে এসে তাকে কলকাতায় ভর্তি করে হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছিলেন। আর ফিফথ ইয়ারে পড়তে পড়তেই বিকাশের সঙ্গে তার আলাপ। সেই আলাপের দিনটা থেকেই জীবনের এক আশ্চর্য জটিলতার ভেতর পা দিয়েছিল সোমা।
হঠাৎ কানের পাশ থেকে তপতী ডাকল, সোমা–ওই চরটা দেখছিস
সোমা চমকে উঠল। স্টিমার তখন মাঝনদীতে; প্রকাণ্ড এক চরের পাশ দিয়ে ওরা যাচ্ছিল। সোমা সেদিকে তাকাল।
তপতী বলল, চরটা ফার্স্ট ক্লাস না?
সেই সাহেবগঞ্জে নামবার পর থেকে কত কী দেখাচ্ছে তপতী। বায়োস্কোপের বাক্সে চোখ লাগাবার পর বায়োস্কোপওলা যেমন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, আগ্ৰাকা তাজমহল দেখো, কুতুব মিনার দেখো, হাওড়া ব্রিজ দেখো, বম্বাইকা সড়ক দেখো,তেমনি তপতী ক্রমাগত বলে যাচ্ছে সাঁওতাল পরগনার পাহাড় দ্যাখ, নদী দ্যাখ, আকাশ দ্যাখ, নদীর চর দ্যাখ-ইত্যাদি ইত্যাদি–