আপনি ভেবেছেন কী?
কী ব্যাপার?
আমার কলকাতা যাওয়া কি আপনার ইচ্ছার ওপর নির্ভর?
আপাতত।
লোকটার মতলব কী কে জানে। ভাত ভাবে জানালার বাইরে তাকাতে লাগল সোমা। এখন গাড়িটা যেখানে সেটা একটা মেঠো পথ। দুধারে ঝুপসি আম বাগান। মৃন্ময় কী বুঝেছিল, সে-ই জানে। বলল, এই জায়গাটাকে আমাদের বিহারের পলাশী বলতে পারেন। আরেকটা খবর আপনাকে দিচ্ছি, এখান থেকে তিন-চার মাইলের মধ্যে কোনও দেহাত নেই, লোকজন নেই। চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ আসবে না।
ভয়ার্ত রুদ্ধ গলায় সোমা বলল, আপনি কী চান?
গাড়ি থেকে নামুন, বলছি।
নিজের ইচ্ছায় নয়, অদৃশ্য কোন শক্তি সোমাকে যেন ধাক্কা মেরে মেরে গাড়ির বাইরে নামিয়ে নিয়ে গেল। তাকে একটা আমগাছের মোটা শিকড়ের সঙ্গে বসিয়ে খানিকটা দূরে মুখোমুখি বসল মৃন্ময়; তারপর পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরিয়ে নিল।
কাঁপা গলায় সোমা বলল, কী বলবেন বলুন
অত তাড়াতাড়ি কি আছে, আজ তো আর ট্রেন ধরতে হবে না।
না হোক; আমি তপতীদের বাড়ি ফিরে যেতে চাই।
নিশ্চয়ই। আমিও তোত সেখানেই ফিরব। আর তপীদের বাড়ি যেতে হলে আমার সঙ্গেই আপনাকে যেতে হবে।
সোমা চুপ করে রইল।
সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে অনেকগুলো ধোঁয়ার আংটি ছাড়ল মৃন্ময়। তারপর বলল, আপনার কথা আমার জানতে ইচ্ছে করে।
জেনে লাভ?
লাভ হয়তো নেই।
তবে?
কৌতূহল।
আমি যদি আপনার কৌতূহল না মেটাই?
মেটাতেই হবে।
আপনার হুকুমে?
না। আপনার নিজের জন্য।
তার মানে?
হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল মৃন্ময়, অন্যমনস্কর মতো ক পা হাঁটল। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে খুব গাঢ় গলায় বলল, আপনি খুব দুঃখী, না?
আচমকা বুকের ভেতর অনেকগুলো এলোমেলো ঢেউ খেলে গেল সোমার। স্মমিত স্বরে সে বলল, কে বলেছে আপনাকে?
নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে মৃন্ময় বলল, এখানে একটা দুঃখী মানুষ আছে, সে-ই বলে দিয়েছে।
মৃন্ময়ের জীবনে যে বেদনা আছে, সোমা তার কিছু আভাস পেয়েছে। সে বলল, আপনার ধারণাটা ভুলও তো হতে পারে।
বুকের ওপর আঙুলটা ছিলই। মৃন্ময় বলল, এখান থেকে যে বলে সে ভুল বলে না। তা ছাড়া
কী?
আপনি নিজেও বুঝিয়ে দিয়েছেন আপনি কত দুঃখী।
আমি?
হ্যাঁ। আপনার চলা-ফেরা, আপনার চুপচাপ বসে থাকা, আপনার চাউনি—এ সবের মধ্যে কী আছে, যে বুঝবার সে ঠিকই বুঝতে পারবে।
সোমা চুপ।
মৃন্ময় আবার বলল, আমার আরো কী মনে হয় জানেন?
সোমা তাকাল।
মৃন্ময় বলতে লাগল, আপনার দুঃখের কথা কোনদিন কারোকে আপনি বলেননি, বা বলতে পারেননি। চেপে রেখে শুধু কষ্টই পাচ্ছেন। আর নিজেকে ধ্বংস করছেন।
লোকটা কি অন্তর্যামী? যাকে সে ভেবেছিল অত্যন্ত হাল্কা ধরনের বাজে লোক তার মধ্যে যে এমন গভীর হৃদয়বান মানুষ আছে, কে ভাবতে পেরেছিল। সোমা চকিত হয়ে উঠল।
মৃন্ময় বলেই যাচ্ছে, আপনি আমাকে বন্ধু বলে মনে করতে পারেন, বলুনএকজনের কাছে বলেও মনের ভার অন্তত খানিকটা কমান।
হঠাৎ সমস্ত অস্তিত্বের ভেতর কী যে হয়ে গেল, কী নিদারুণ প্রতিক্রিয়া, সোমা বলতে পারবে না। এ ভাবে কেউ কোনদিন তার কথা শুনতে চায়নি।
বিচিত্র এক সম্মোহের ঘোরে বিকাশের সঙ্গে জড়ানো তার জীবনের সেই দুর্ঘটনাটার কথা বলে গেল সোমা। বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কাঁদতে লাগল।
কতক্ষণ কেঁদেছে জানে না, এক সময় সোমা অনুভব করল, তার পিঠে একটি সহানুভূতিময় হাতের কোমল স্পর্শ এসে পড়েছে। চমকে মুখ তুলতেই দেখতে পেল দুচোখে অপার স্নেহ তাকিয়ে আছে মৃন্ময়! চোখাচোখি হতেই সে বলল, পুওর গার্ল।
সোমা উত্তর দিল না।
মৃন্ময় আবার বলল, কিন্তু এত ভেঙে পড়লে তো চলবে না। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। জানেনা, আমার জীবনেও কিছু দুঃখ আছে। একটি মেয়েকে একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম, সে আমাকে ঠকিয়ে আমার যথাসর্বস্ব নিয়ে আমারই এক বন্ধুর সঙ্গে একদিনে চলে গেল। তারপরেও দ্যাখ আমি কেমন হাসি, গান গাই, হই-হল্লা করি। ওই ঘটনাটা একেবারে ভুলেই গেছি।
হঠাৎ যেন চোখের ওপর ধারালো আলো এসে পড়ল। মৃন্ময়ের এই গান-টান, হল্লা-হুঁল্লোড়–সব যেন কান্নারই ছদ্মবেশ। রবীন্দ্রনাথের কী একটা কবিতা যেন আছে, এই মুহূর্তে মনে করতে পারল না সোমা।
অনেকক্ষণ পর সোমা বলল, আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল।
মৃন্ময় বলল, ধুস, এর জন্যে কোন কিছুই শেষ হয় না।
মৃন্ময়ের চোখে পরিপূর্ণ দৃষ্টি রেখে সোমা বলল, সত্যিই হয় না?
না, তোমার মাথায় ওটা ফিক্সেশানের মতো আটকে আছে। কিন্তু জীবনে শেষ বলে কোন কথা নেই। রোজ সেখানে নতুন করে শুরু করা যায়। সন্ধে দুজনে উঠে পড়ল।