না।
কী না?
এসব আমার ভালো লাগে না।
জিনিসটা আগে দেখুন, শুনুন। তারপর তো ভালো-লাগা খারাপ-লাগার প্রশ্ন।
আমাকে ক্ষমা করুন; এ ব্যাপারে আমার কিছুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই।
একদিন মৃন্ময় এক কাণ্ডই করে বসল। সোমার ঘরে এসে বলল, আজ আপনাকে আমি একটা উপহার দিতে চাই।
উপহার! বিমূঢ়ের মতো উচ্চারণ করল সোমা।
ইয়েস ম্যাডাম।
কিন্তু
কী?
আপনার উপহার আমি হাত পেতে নেব কেন?
খুব সামান্য জিনিস।
সামান্যই হোক আর অসামান্যই হোক, আমি নিতে পারব না। মনে মনে ভীষণ রাগ হচ্ছিল সোমার। লোকটার স্পর্ধা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
মৃন্ময় বলল, দেখুন, জিনিসটা আমি পয়সা দিয়ে কিনিনি। কেনা হলে দিতাম না। আমি একজন আর্টিস্ট, জানেন তো?
শুনেছি।
আমি একটা ছবি এঁকেছি, সেটাই দিতে চাই।
সোমা উত্তর দিল না।
মৃন্ময় পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে সোমার সামনের টেবলটায় রাখল। যে ছবিটা আঁকা হয়েছে সেটা একপলক দেখেই সমস্ত রক্ত মাথায় গিয়ে চড়ল সোমার। ছবিটা তারই; তলায় লেখা আছে–বিষাদের প্রতিমা–দুঃখিনী। কখন কোন ফাঁকে চোরের মতো তার ছবি এঁকে নিয়েছে মৃন্ময়, কে জানে।
ঘাড়ের কাছে একটা শির কট করে ছিঁড়ে গেল যেন। হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো চিৎকার করে উঠল সোমা, অসভ্য, জানোয়ার! বেরিয়ে যান এখান থেকে বেরিয়ে যান
ফস করে আলো নিভে যাবার মতো মুখটা কালো হয়ে গেল মৃন্ময়ের। নিজেকে টেনে তুলতে তুলতে সোমাকে একবার দেখল সে, তারপর আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে চলে গেল।
তার পর থেকে সোমার ঘরে আর আসেনি মৃন্ময়। কিন্তু যখনই সোমা চোখ তুলে জানালার বাইরে তাকিয়েছে তখনই দেখেছে, একজোড়া চোখ তারই দিকে তাকিয়ে আছে। সে চোখ কোমল, সহানুভূতিময়, আর্দ্র। অভদ্র ইতর মৃন্ময় যে এভাবে তাকাতে পারে, কে ভাবতে পেরেছিল। সোমা খুবই অস্বস্তিবোধ করতে লাগল।
.
১০.
আরো কদিন পর হঠাৎ সোমা বলল, আমি আজ কলকাতা চলে যাব।
বাড়ির সবাই চেঁচামেচি জুড়ে দিল, কিছুতেই না কিছুতেই না। আজ যাওয়া হতেই পারে না।
দোলন-ঝুলন-পিন্টু, অনেক করে থাকতে বলল, তপতীর বাবা বোঝালেন, তপতীও চিৎকার-টিৎকার করল, তপতীর মা বললেন, তিন বছর পর যা-ও এলে, দুদিন থাকতে না থাকতেই চলে যাবে? আর কটা দিন থেকে যাও মা! কিন্তু কারো কথা শুনল না সোমা।
তপতী বলল, কলকাতায় তো তোর কোনও কাজ নেই।
অবুঝের মতো সোমা বলল, না থাক, তবু যাব। এখানে আমার আর ভালো লাগছে না।
শেষ পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক হল। কিন্তু তাকে কাটিহারে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে কে? তপতীর বাবা যাবেন না, পিন্টুর দুদিন ধরে জ্বর, আর তপতী আগে থেকেই সোমেশের সঙ্গে এক জায়গায় যাবার প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছে।
সোমা বলল, কারোকেই যেতে হবে না; শেয়ারের ট্যাক্সিতে তুলে দিলে আমি একাই চলে যেতে পারব।
তপতীর মা বললেন, তাই কখনও হয়? ভালো কথা, মৃন্ময়ই তো আছে। সে-ই কাটিহারে তুলে দিয়ে আসবে।
সোমা একবার ভাবল, আপত্তি করে। কিন্তু কিছু বলল না।
.
কাটিহার থেকে দুপুর দুটোয় মনিহারি ঘাটের ট্রেন। শেয়ারের ট্যাক্সি না, কোত্থেকে একটা প্রাইভেট গাড়ি যোগাড় করে আনল মৃন্ময়। এখান থেকে কাটিহার আর কতক্ষণের রাস্তা; মোটরে গেলে বড় জোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বারোটা বাজবার আগেই খানিকটা সময় হাতে নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল।
ড্রাইভার নেই; গাড়িটা মৃন্ময় নিজেই চালাচ্ছিল। পিছনের সিটে চুপচাপ বসে আছে সোমা। কেউ কথা বলছিল না।
সেদিনের সেই ব্যবহারের জন্য মনে মনে লজ্জিত ছিল সোমা; রাগের মাথায় ওভাবে বলা তার উচিত হয়নি। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে দ্বিধার গলায় সে ডাকল, মৃন্ময়বাবু
সামনের দিকে চোখ রেখেই মৃন্ময় সাড়া দিল, বলুন
সেদিনের ব্যাপারটার জন্যে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
ক্ষমা আবার কী।
দেখুন, ওইসব কথা বলা আমার অন্যায় হয়েছে। জীবনে হয়তো আর কখনও আপনার সঙ্গে দেখা হবে না; আপনি যদি ওই ব্যাপারটা মনে করে রাখেন আমি খুব কষ্ট পাব।
মনে করে রাখব না। তাছাড়া
কী?
কেউ কিছু বললে আমার বেঁধে না; আমার গায়ের চামড়া গন্ডারের মতো পুরু।
সোমা আর কিছু বলল না। মৃন্ময়ও চুপ করে থাকল।
আজ মৃন্ময় বড় বেশি সংযত। সোমা কথা না বললে আগে থেকে সে কিছু বলছে না, কোনওরকম মন্তব্যও করছে না। এমন কী পিছন ফিরে একবার সোমাকে দেখছেও না।
এক ঝলক মৃন্ময়কে দেখে নিয়ে জানালার বাইরে তাকাল সোমা।
গাড়িটা চলেছে তো চলেছেই। দুধারে আদিগন্ত মাঠ, পানিফলে বোঝাই মাইলের পর মাইল বিল, টুকরো টুকরো রবিশস্যের খেত, সিসম গাছের জটলা, ঝোপ-ঝাড়।
কতক্ষণ গাড়িটা চলেছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ হাতঘড়িতে চোখ পড়তেই চমকে উঠল সোমা, চারটে বাজে। সে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, এ কী, চার ঘণ্টা গাড়ি চলছে, এখনও কাটিহার গিয়ে পৌঁছালাম না?
মৃন্ময় খুব সহজ গলায় বলল, আমরা কাটিহারের দিকে গেলে তো পৌঁছুবেন—
তার মানে?
তার মানে আমরা অন্য রাস্তায় চলে এসেছি।
উদ্বিগ্ন মুখে সোমা বলল, তা হলে কলকাতায় যাব কী করে?
মৃন্ময় বলল, কলকাতায় আজ আর যাওয়া হচ্ছে কই? দুটোর ট্রেন দুঘন্টা আগে কাটিহার ছেড়ে চলে গেছে। আজ আর মণিহারি ঘাটের ট্রেন নেই। যেতে হলে কাল। নিশ্চয় আপনাকে কাটিহারে ট্রেন ধরিয়ে দিয়ে আসব।