সোমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না তপতী। বলল, এত মোট-ঘাট আমরা নামতে পারব না, দাঁড়া কুলি ডাকি। কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে একটা কুলী ডেকে আনল সে, বলল, সামান উঠাও–
কুলিটা জিগ্যেস করল, কিধার যায়েগী মাঈজি?
ঘাটগাড়ি।
কুলিটা সুটকেশ-টুটকেশ চটপট মাথায় তুলে এগিয়ে চলল। তার সঙ্গে যেতে যেতে পিছন ফিরে একবার কামরাটা দেখে নিল তপতী–কিছু পড়ে-টড়ে আছে কিনা। না, কিছু নেই। দু-তিনটে বেহারি ভদ্রলোক জানালার ধারে বসে দাঁতন করছেন। এক বিপুলদেহ মারোয়াড়ি আর তার স্ত্রী-কাল ট্রেনে উঠে এদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, এখনও পাল্লা দিয়ে ঘুমোচ্ছে, জামা কাপড় আলুথালু। বিশ নম্বর কড়াইর মতন তাদের বিরাট পেট নিশ্বাসের তালে তালে ওঠা নামা করছে।
প্ল্যাটফর্মে নামতেই ঠান্ডা কনকনে হাওয়া ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিল। তাড়াতাড়ি শাড়ি দিয়ে গলা হাত-টাত ঢেকে সোমা বলল, এখানে তো বেশ শীত রে–
তপতী মাথা নাড়াল, হ্যাঁ
আজ মার্চের আট তারিখ। এর মধ্যেই কলকাতার গরম পড়তে শুরু করেছে; ফ্যান ছাড়া রাত্তিরে ঘুমনো যায় না। অথচ কলকাতা থেকে শ দুই মাইল দূরে এই জায়গাটা প্রাণ ধরে এখনও শীতটাকে বিদায় দিতে পারেনি।
তপতী বলল, চারদিকে পাহাড়-টাহাড় আছে কিনা; তাই ঠান্ডাটাও আছে।
প্ল্যাটফর্মে টিউব লাইটগুলো জ্বলছিল; কালো কোট-পরা রেল-বাবুরা চারদিকে ছোটাছুটি করছিল। এধারে ওধারে যাত্রীদের ভিড়, কুলিদের জটলা।
গেটে টিকিট জমা দিয়ে ওরা স্টেশনের পিছন দিকে চলে এল। সেখানে লাইনের ওপর আবছা অন্ধকারে লম্বা সরীসৃপের মতন একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। কুলিটা একটা ফাঁকা কামরায় মালপত্র তুলে দিয়ে ভাড়া নিয়ে চলে গেল।
হোল্ডল থেকে চাদর বার করে বেঞ্চের ওপর পাততে পাততে তপতী বলল, আর মোটে ঘণ্টা আটেক; তারপরেই বাড়ি পৌঁছে যাব, বুঝলি।
তপতীকে খুব হাসিখুশি আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। অনেকদিন পর বাড়ি ফিরতে পারলে কার না আনন্দ হয়। সোমা কিছু বলল না।
তপতী আবার বলল, এখান থেকে সগরিগলি ঘাট যাব; সেখান থেকে স্টিমারে মণিহারি ঘাট। মণিহারি ঘাট থেকে ট্রেনে কাটিহার। কাটিহার থেকে ট্যাক্সিতে পূর্ণিয়া। কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে বলল, এখন ছটা; ঠিক দুটোয় দেখবি বাড়িতে হাজির হয়েছি।
সোমা উৎসাহ দেখাল না। নিরুৎসুক গলায় বলল, ও, তাই নাকি
তপতী নিজের খেয়ালে বলে যেতে লাগল, স্টিমারে নদী পার হওয়াটায় গ্র্যান্ড লাগবে। ট্যাক্সিতে কাটিহার থেকে পূর্ণিয়া ট্রিপটাও খুব এনজয় করবি।
আগের সুরেই সোমা বলল, বেশ তো।
সারা রাত ঘুম হয়নি। চোখ জ্বালা জ্বালা করছিল সোমার। মাথার ভেতরটা ঝিম ঝিম করছে। ঘাড়ের কাছটায় কেউ যেন হাজারটা পিন ফোঁটাচ্ছে। ক্লান্ত গলায় সোমা বলল, এখানে জল-টল পাওয়া যাবে রে? বাসি মুখটা না ধুতে পারলে বিশ্রী লাগছে।
নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। দাঁড়া আনছি। বড় বড় দুটো ওয়াটার বটল নিয়ে স্টেশনে চলে গেল তপতী; একটু পরেই ভর্তি করে ফিরে এল।
সোমা মুখ-টুখ ধুয়ে ঘাড়ে-গলায় জল দিল। সাঁওতাল পরগণার হিমেল বাতাস ছিলই। আস্তে আস্তে অসুস্থ স্নায়ু জুড়িয়ে আসতে লাগল তার।
তপতীও মুখ ধুয়ে নিয়েছিল। ধুয়েই সে আবার স্টেশনে ছুটল। এবার ডেকে আনল একটা টি-ভেন্ডারকে। ভেণ্ডারটা দুজনকে চা দিয়ে চলে গেল।
তপতী বলল, এখানকার চা যাচ্ছেতাই; গরম জলই বলতে পারিস। কী আর করবি, এ-ই খা, কাটিহার গিয়ে ভালো চা-খাওয়াব।
নিঃশব্দে ভড়ে চুমুক দিল সোমা। চা-টা যেমনই হোক; খাবার পর মাথার ঝিমঝিম ভাবটা কমে আসতে লাগল।
দেখতে দেখতে চারদিক ফর্সা হয়ে গেল। একটু আগে আবছা মতন যে অন্ধকারটা আকাশ এবং পাহাড়-টাহাড়ের গায়ে জড়াজড়ি করে ছিল, কেউ যেন লাটাইতে সুতো গুটোনোর মতন একটানে সেটা তুলে নিয়ে গেল। অন্ধকার নেই, তবে সিল্কের মতন সাদা কুয়াশা সাঁওতাল পরগনার দীর্ঘ রেঞ্জটার মাথায় আটকে আছে। সূর্যটা উঁকি ঝুঁকি দিতে দিতে ঝাঁপ করে দিগন্তের তলা থেকে উঠে এল। মার্চের এই সকালে ঝক ঝক পাখি বেরিয়ে পড়েছে। সারা গায়ে ভোরের আলো মেখে তারা পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছিল।
পাহাড়ের রেঞ্জটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে তপতী বলল, দ্যাখ দ্যাখ সোমা, কী ফাইন, না?
সাঁওতাল পরগনার ওই পাহাড় আকাশের কোল ঘেঁষে চলেছে তো চলেইছে। মাইলের পর মাইল পেরিয়ে হয়তো, দেশ থেকে দেশান্তরে। এদিকে আর কখনও আসেনি সোমা। সাঁওতাল পরগনার এই সকালবেলাটা নিজের অজান্তে কখন যেন তাকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। পাহাড় দেখতে দেখতে সে আধফোঁটা গলায় বলল, সত্যি ফাইন রে–
সেই ছেলেবেলা থেকে এই পাহাড়ের রেঞ্জটা দেখছি। কতবার দেখেছি। তবু এখনও ভালো লাগে।
ওখানে লোকজন থাকে?
সাঁওতাল-টাওতালরা থাকে। ওদের জন্যেই তো সাঁওতাল পরগনা নাম হয়েছে। সোমা মনে মনে ভাবল, ঠিক তো। জায়গাটার নাম শুনেই সাঁওতালদের কথা তার মনে পড়া উচিত ছিল। বলল, তুই কখনও ওদিকে গেছিস?
না ভাই, তপতী বলতে লাগল, এই সাহেবগঞ্জ থেকে যতটুকু দেখা যায়, ব্যস, ওই পর্যন্ত
সোমা আর কিছু জিগ্যেস করল না।
তপতী এদিক সেদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ওই দ্যাখ দ্যাখ, কী লাভলি সূর্যটা
সোমা সেদিকে তাকাল। সব ব্যাপারেই তপতীর উচ্ছ্বাস একটু বেশি। তবু সুযোদয়টাকে ভালোই লাগল, সোনার থালার মতন সেটা দাঁড়িয়ে আছে।