সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তপতীর মায়ের ওপর। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে কার অসুখ-বিসুখ করল, চাকর-বাকররা কাজে ফাঁকি দিচ্ছে কিনা–সব দিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
তপতীর ভাইবোনেরা ভারি শান্ত, ভদ্র বিনয়ী। বাড়িতে তারা আছে কিনা, টের পাওয়া যায় না। তবে তপতীটা দারুণ চঞ্চল। দুমদাম হাঁটছে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে, জোরে জোরে শব্দ করে হেসে উঠছে। আর একজনের অস্তিত্বও দারুণভাবে টের পাওয়া যায়–সে মৃন্ময়। নিস্তব্ধ বাড়িতে হঠাৎ হঠাৎ সে গেয়ে ওঠে, তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে সুপ্ত রাতে। আমার ভাঙল যা তাই ধন্য হল চরণপাতে। কিংবা মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে সেদিন ভরা সাঁঝে কিংবা কইও কথা বন্ধুর কাছে, জল ছাড়া মীন কয়দিন বাঁচে কিংবা এ দেখো তো য়ঁহা, কোই নহী হ্যায়, কোই ভী নহী, পাশ আ যাও না– ইত্যাদি ইত্যাদি
মৃন্ময় সম্বন্ধে আরো কিছু কিছু জেনেছে সোমা। নিজে যেচে জানতে যায়নি, তপতীদের কথাবার্তা থেকে টুকরো টুকরো কানে এসেছে। মৃন্ময়ের মা-বাবা নেই। ছেলেবেলা থেকেই ফুলমাসি অর্থাৎ তপতীর মার কাছে সে মানুষ। তার স্বভাবটা অদ্ভুত; কোনও কিছুর প্রতিই বিশেস আকর্ষণ নেই। বড় বড় পাবলিসিটি ফার্মে ভালো ভালো চাকরি নিয়ে কতবার কলকাতা-বোম্বাই গেছে। কিন্তু দু-চার মাস, ভালো না লাগলেই দুম করে ছেড়ে-ছুঁড়ে চলে এসেছে। আপাতত আছে নয়া দিল্লিতে, কবে ছেড়ে দেবে ঠিক নেই। মৃন্ময়ের জীবনে একটা দুঃখ আছে, তা বিবাহ-ঘটিত। দুঃখটা ঠিক কী ধরনের এখনও জানা হয়নি।
.
যাই হোক মৃন্ময় আর তপতীর সঙ্গে একদিন নেপাল বর্ডার দেখে এল সোমা, একদিন মহানন্দা ব্রিজ পেরিয়ে গেল ওয়েস্ট দিনাজপুর। আরেকদিন গেল ফরবেসগঞ্জ। মাঝে মাঝে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে সাইকেল রিকশায় দূর দেহাতেও চলে যেতে লাগল।
এর মধ্যেই একদিন খবর এল সোমেশ আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছে। দেশে আসার কথা ছিল আরো পরে। কিন্তু হঠাৎ সুযোগ পেয়ে যাওয়ার আগেই এসে গেছে।
সোমেশের সঙ্গে সোমার আলাপ করিয়ে দিল তপতী। ভদ্র, নম্র, বুদ্ধিদীপ্ত সোমেশকে দেখে যত না খুশি হল সোমা তার চাইতে অনেক বেশি হল বিষণ্ণ। এমন বিষাদ আগে আর কখনও অনুভব করেনি সে। তার মনে হতে লাগল, চারপাশের সবাই যেন তাকে বঞ্চিত করেছে।
সোমেশ আসার দুদিন পর ছিল হোলি। সোমার রঙ খেলার ইচ্ছা ছিল না। তপতী সোমেশ আর মৃন্ময় জোর করে তাকে ঘরের বাইরে বার করল। অনিচ্ছুক সোমা কারো গায়ে রঙ-টঙ দিল না; তপতীরা অবশ্য আবির-টাবীর দিয়ে ওকে ভূত সাজিয়ে ছাড়ল।
রঙটা শুধু গায়েই লাগল। মনের ভেতরটা একেবারে বর্ণহীন বলা যায়, শীতের আকাশের মতো ধূসর।
হোলির পর থেকে নিজেকে আবার গুটিয়ে আনতে লাগল সোমা। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গা, তার গাছপালা, মানুষ এবং সুন্দর দৃশ্যপট তাকে খুব বেশিদিন অন্যমনস্ক রাখতে পারল না। সেই পুরোনো বিষাদ আবার সোমার চারপাশে ঘন হতে লাগল। ঘর থেকে বেরুতে আর ইচ্ছা হয় না।
সোমেশ ফিরে আসার পর বাড়িতে আর কতটুকু সময় থাকে তপতী। সারাদিনই সে সোমেশের সঙ্গে ঘুরছে। অবশ্য সোমাকেও তাদের সঙ্গে যেতে বলে, সোমেশও দু-একবার এসে অনুরোধ করেছে, সোমা যায়নি। তার কিছুই ভালো লাগে না।
.
০৯.
তাদের জন্য নির্দিষ্ট সেই ঘরটায় সারাদিনই চুপচাপ বসে থাকে সোমা, মাঝে মধ্যে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। সামনের বড় জানালাটার বাইরেই গোলাপ-বাগান, বাগানের পর রাস্তার ওধারে গাছপালা, অনেক উঁচুতে আকাশ।
সে-সব দিকেও চোখ যায় সোমার, কিন্তু কিছু যেন দেখতে পায় না সে।
দোলন-ঝুলন কদাচিৎ এ ঘরে আসে। এসেও–কী করছেন? চা খাবেন কি? জাতীয় দু-একটা কথা বলেই চলে যায়। তপতীর মা অবশ্য অনেকবার এসেই তার খোঁজ নিয়ে যান।
তবে সব চাইতে যে বেশি আসে সে মৃন্ময়। দরজার বাইরে থেকেই চিৎকার করে বলে, মে আই কাম ইন বলেই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। অনুমতির জন্য অপেক্ষা পর্যন্ত করে না।
সোমা বিরক্ত চোখে তাকায়; কিছু বলে না।
চেয়ারে জাঁকিয়ে বসতে বসতে মৃন্ময় বলে, আপনি একটা ফ্যাস্টাফ্যাটাস, সারাদিন ঘরের ভেতর কী করে যে বসে থাকেন!
নীরস গলায় সোমা বলে, আমার শরীরটা ভালো না।
কী হয়েছে?
সোমা উত্তর দেয় না।
মৃন্ময় উদ্বেগের গলায় বলে, ডাক্তারকে খবর দেব?
সোমা বলে, না। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।
একটু চুপ। তারপর সোমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে মৃন্মম নীচু গলায় বলে, আমার কী মনে হয় জানেন?
কী? কপাল কুঁচকে যেতে থাকে সোমার।
শরীর আপনার ভালোই আছে, গোলমালটা অন্য জায়গায়।
তার মানে?
নিজেই ভেবে দেখুন
লোকটা কি অন্তর্যামী? সোমা চমকে ওঠে। তারপরেই তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, অনুগ্রহ করে আপনি এখন যান। আমাকে একটু একা থাকতে দিন।
কখনও এসে মৃন্ময় বলে, আপনাকে আজ একটা জিনিস দেখাব।
সোমা বিরক্ত অথচ জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। মৃ
ন্ময় বলতে থাকে, নওটঙ্কী কাকে বলে জানেন?
না।
প্রচুর নাচ গান দিয়ে একটা পালার মতো। বাংলাদেশে যেমন যাত্রা, অনেকটা সেই রকম।
নিস্পৃহ সুরে সোমা বলে, ও–
আজ ভাট্টাবাজারের কাছে নওটঙ্কীর গান আছে। শুনতে যাবেন? উৎসাহের গলায় মৃন্ময় বলতে থাকে, খুব ভালো লাগবে; দারুণ এনজয় করবেন। জিনিসটা যাকে বলে একেবারে সয়েল থেকে উঠে এসেছে, এখানকার মাটির গন্ধ মাখানো।