সোমা বুঝেছিল, বিকাশ বিয়ে করবে না। অথচ তার কথা না শুনে উপায়ও ছিল না। পরের দিন ডাক্তারের প্রাইভেট নার্সিং হোমে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে সোমা যখন ফিরে এসেছিল তখন তার দুশ্চিন্তা নেই; বিকাশের ভাষায় আগের মতোই সে কুমারী। কিন্তু এই কয়েক ঘণ্টায় তার মধ্যে নিদারুণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো কিছু একটা ঘটে গেছে। নিজেকে সে ততক্ষণে আবিষ্কার করে ফেলেছে। যতই ঠোঁট নখ ম্যানিকিওর করুক, যতই হেয়ার-টনিকে চুল ফাপাক, বিয়ারের গেলাসে চুমুক দিক নাভির তলায় শাড়ি পরুক, তার ভেতর চিরদিনের সংস্কার-ভীরু একটি মেয়ে আছে। সেদিন থেকে সে আর হোস্টেল থেকে বেরুত না। জীবন মানে এক নিষ্ঠুর খেলোয়াড় খোলামকুচির মতো তাকে অসীম শূন্যতায় ছুঁড়ে দিয়েছিল। সমস্ত পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে এনেছিল সোমা; তাকে ঘিরে অন্তহীন বিষাদ জমতে শুরু করেছিল।
তারপরও বিকাশ অনেকবার এসেছে, রুবিরা এসেছে। সোমা দেখা করেনি। ওয়েটিং রুম থেকেই ওরা ফিরে গেছে। লক্ষৌতে এক-আধবার গেছে কিন্তু দু-চার দিনের বেশি থাকতে পারেনি। তার মনে হয়েছে, বেশিদিন থাকলে বাবা-মার চোখে সে ধরা পড়ে যাবে। নিদারুণ পাপবোধ তখন তাকে নিয়ত দগ্ধ করছে।
যাই হোক এই সময় একটা কলেজে লেকচারারশিপ পেয়ে গিয়েছিল সোমা। পড়াতে গিয়ে ওখানেই তপতীর সঙ্গে আলাপ। আলাপের দিন থেকেই এই উজ্জ্বল প্রাণবন্ত মেয়েটা তার বন্ধু। যতদিন গেছে তপতীর প্রীতি, তপতীর ভালোবাসা তাকে মুগ্ধ করেছে। পৃথিবীতে আলো-হাওয়া-জলের মতো তপতীর বন্ধুত্বের তুলনা নেই।
বিষণ্ণ বিবর্ণ মুর্তির মতো তাকে সারাদিন চুপচাপ থাকতে দেখে তপতী কতদিন ধরে বলে আসছে, পূর্ণিয়ায় নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত এত কাল পর পূর্ণিয়া আসার সময় হল তার।
.
কতক্ষণ অন্যমনস্ক ছিল, সোমা জানে না। হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হাসিতে চমকে উঠল সে। দারুণ হাসছে তপতী; টাঙ্গাওলার পাশে বসে মৃন্ময়ও হাসছে।
মৃদু গলায় সোমা বলল, কী হল, হাসছিস যে?
তপতী বলল, তোর কাণ্ড দেখে। কী ভাবছিলি অত?
সোমা থতিয়ে গেল, কই, কিছু না তো।
সামনের সিট থেকে মৃন্ময় বলে উঠল, কিছু না বললেই হবে! আমরা দুজনে কম করে আটাত্তর বার ডেকেছি; আপনার সাড়া নেই। যার ধ্যান করছিলেন, সত্যিই সে ভাগ্যবান।
সোমার একবার ইচ্ছে হল, উঠে গিয়ে লোকটার গালে চড় কষায়। কিন্তু কিছুই করল না।
আরো ঘন্টাখানেক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তারা গোলাপবাড়িতে ফিরে এল।
.
০৭.
বাড়ি ফিরে দেখা গেল তপতীর বাবা এসে গেছেন। তপতীর মার মতো তপতীর বাবার দিকে তাকিয়েও চোখ ফেরানো যায় না। তাকে দেখলে মনে হয়, গ্রিক পুরাণের পৃষ্ঠা থেকে দেবদূত নেমে এসেছে।
তপতীর বাবার সঙ্গে আলাপ হল। মানুষটি ভারী সরল, অমায়িক। চোখ দুটি স্নেহে ভাসো-ভাসো। বললেন, তুমি কিছু মনে করোনি তত মা?
বুঝতে না পেরে সোমা বলল, কী ব্যাপারে?
তোমরা যখন এলে তখন আমি বাড়ি ছিলাম না। তোমার জন্যে অন্তত থাকা উচিত ছিল।
না না, কিছু মনে করিনি। মাসিমাই তো ছিলেন। দোলন-ঝুলন পিন্টু ছিল। আপনি না থাকতে একটুও অসুবিধা হয়নি।
দুম করে মৃন্ময় বলে উঠল, যাঃ বাবা, আমি যে একদিন আগে গিয়ে মনিহারি ঘাট থেকে নিয়ে এলাম, আমার কথাটাই বাদ চলে গেল! একেই বলে বরাত। সোমা উত্তর দিল না।
কথায় কথায় অনেক রকম প্রসঙ্গ এল। সোমাদের বাড়ির কথা, দেশের কথা, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা, কলকাতার কথা। দেখা গেল, তপতীর বাবা কোনও ব্যাপারেই বিশেষ খবর-টবর রাখেন না, রাখার উৎসাহও নেই। নাইনটিন ফরটি ওয়ানে তিনি শেষবার কলকাতায় গিয়েছিলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন সম্বন্ধে তার ধারণা ভাসা-ভাসা। আলাপ-টালাপ করে মনে হতে লাগল, ভদ্রলোক এ যুগের নন।
ওঁদের গল্পের মধ্যেই তপতীর মা এসে তাড়া দিতে লাগলেন, রাত হয়েছে এবার খেতে চল সব।
.
খাবার টেবলে বসে আবার গল্প শুরু হল।
হঠাৎ কী মনে পড়তে তপতী তাড়াতাড়ি তার মাকে বলল, মা, তুমি নাকি মৃন্ময়দাকে চিঠি দিয়ে আনিয়েছ?
তপতীর মা বললেন, হ্যাঁ।
কেন?
ওর একটা বিয়ে দেব। আমি মেয়ে দেখেছি।
টেবলের দূর প্রান্ত থেকে সোমা নিজের অজান্তেই মৃন্ময়ের দিকে তাকাল। কী আশ্চর্য, মৃন্ময়ও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই মুখ নামিয়ে নিল সোমা। আর মৃন্ময় হেসে হেসে তপতীর মাকে বলল, ইঁদুর কলে পা দিতে আমি আর রাজি না।
তপতীর মা বললেন, বিয়েটাকে ইঁদুর কল বলছিস কেন মৃন্ময়?
মৃন্ময় বলল, আমার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে ওই কথাটা ছাড়া আর কিছুই মনে আসে না।
বারবার এক রকম হবে তার কি কিছু মানে আছে?
ঘরপোড়া গরু তো বুঝতেই পারছ?
আগেরবার নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিলি, এবারটা আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে দ্যাখ, ভালো হয় কিনা।
মৃন্ময় চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর তপতীর বাবা একসময় ডাকলেন, মৃন্ময়
মৃন্ময় তাকাল। তপতীর বাবা বললেন, সোমা এসেছে, তোরা ওকে পূর্ণিয়ার চারদিকটা ভালো করে দেখিয়ে দে।
মৃন্ময় উৎসাহিত হয়ে উঠল, নিশ্চয়ই। শুধু পূর্ণিয়া কেন, একদিন যোগবাণীতে গিয়ে নেপাল বর্ডার দেখিয়ে আনব, একদিন যাব মহানন্দ ব্রিজে–একের পর এক তালিকা দিয়ে যেতে লাগল মৃন্ময়।
.
০৮.
দিন দুয়েকের মধ্যে তপতীদের বাড়ির জীবনযাত্রা মোটামুটি জেনে ফেলল সোমা। তপতীর বাবা সকাল হলেই স্নান-টান সেরে চা খেয়ে টিফিন কেরিয়ারে খাবার-টাবার বোঝাই করে পুরোনো আমলের একটা সাইকেলে বেরিয়ে পড়েন। মানুষটি অদ্ভুত, সারাদিন নাকি নির্জন মাঠের মাঝখানে বসে থাকেন। পাখি দ্যাখেন, ফুল দ্যাখেন, আকাশ দ্যাখেন, গাছপালা পাখি-টাখি দ্যাখেন। মানুষের সঙ্গ বিশেষ পছন্দ করেন না। ফিরতে ফিরতে সন্ধে, কোনওদিন হয়তো খবর এল, দশ মাইল দূরের বনে সাদা শজারু বেরিয়েছে, শুনেই শজারু দেখতে ছুটলেন। কেউ হয়তো বলল অমুক জায়গায় বিচিত্র পাখি দেখা দিয়েছে, কানে আসা মাত্র রওনা হলেন। বিভূতি ভূষণের লেখায় প্রকৃতির মনোহর ছবি দেখেছে সোমা; কিন্তু এমন প্রকৃতি প্রেমিক আগে আর দ্যাখেনি সে।