আধফোটা গলায় সোমা বলেছিল, পরীক্ষা আসছে; এখন আর সময় কোথায়?
বিকাশ বলেছিল, রোজ রোজ তো আর পিকনিক-ফিকনিক হচ্ছে না। তাছাড়া পরীক্ষার এখনও এক বছর দেরি। শুধু বই নিয়ে থাকলেই কি হয়, প্যাস্টাইমও দরকার।
এক সময় ওরা কলকাতায় পৌঁছে গেল। রুবির কথা মতো সোমাকে তার হোস্টেলের কাছে নামিয়ে দিয়ে বিকাশ বলল, তুমি এখানেই থাক নাকি? জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে হোস্টেল বাড়িটা ভালো করে দেখে নিয়েছিল সে।
সোমা মাথা নেড়েছিল।
বিকাশ আবার বলেছিল, হোপ টু মিট ইউ এগেন–ফির মিলেঙ্গে।
উচ্ছ্বাস এবং অনুচ্ছ্বাসের মাঝামাঝি একটা জায়গা থেকে সোমা শুধু বলেছিল, আচ্ছা।
তারপর একটা সপ্তাহে কাটেনি। এক ছুটির দিনের দুপুরে হোস্টেলবাড়ির দোতলায় নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিনেমা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল সোমা, হঠাৎ বিকাশের স্লিপ এল। মেয়েদের হোস্টেল, তাই ওয়েটিং রুম থেকে স্লিপ পাঠাতে হয়েছে। নইলে ও যা ছেলে, দুম করে হয়তো ওপরেই চলে আসত। যাই হোক স্লিপটা হাতে নিয়েও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না সোমা। বিকাশ অবশ্য আবার দেখা করবার কথা বলেছিল। কিন্তু লোকে কত কথাই তো বলে; সব কথা কি রাখবার?
হ্যাঁ আমিই। খুব অবাক হয়ে গেছ, না? বিকাশ হেসেছিল, সেদিনই কিন্তু বলেছিলাম, আবার দেখা হবে। মনে নেই?
সোমা ঘাড় কাত করেছিল, অর্থাৎ আছে।
বিকাশ এবার ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিল, কী করছিলে?
তেমন কিছু না। ভাবছিলাম একটু ঘুমোব।
দুপুরবেলা ঘুমোয় না; চটপট রেডি হয়ে এসো–
কী ব্যাপার?
আর বোলো না, এক কাণ্ড করে ফেলেছি।
কী?
এলিটে দারুণ একটা ছবি এসেছে। তোমার আর আমার জন্যে দুখানা টিকিট কেটে ফেলেছি।
একদিনের আলাপে কেউ যে এভাবে সিনেমার টিকিট নিয়ে হাজির হতে পারে, সোমা ভাবতে পারেনি। বিমূঢ়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলেছিল, টিকিটটা কেটেই ফেললেন! আমি যদি এখন হোস্টেলে না থাকতাম?
একটুও না ভেবে বিকাশ বলেছিল, না থাকলে আর কী হত? টিকিট দুটো ছিঁড়ে ফেলে দিতাম। আর দেরি কোরো না; শো কিন্তু দুটোয়।
সোমা একবার ভেবেছিল, যাবে না। কিন্তু সেই মুহূর্তে বিকাশকে না বলবার মতো শক্তি তার ছিল না। সে শুধু অনুভব করছিল দুর্দান্ত ঝড়ের মতো একটা কিছু তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছে।
সেই শুরু। তারপর থেকে প্রায়ই হোস্টেলে আসতে লাগল বিকাশ। কখনও সে সোমাকে থিয়েটারে নিয়ে যেত, কখনও জি. টি. রোড ধরে অনেকদুর উধাও হত, কোনওদিন যেত ফিল্ম সোসাইটির দারুণ দারুণ এক্সপেরিমেন্টাল ছবি দেখাতে, যেগুলোর গায়ে শুধু সেক্সের ছড়াছড়ি। তবে সব চাইতে বেশি নিয়ে যেত পার্ক স্ট্রিটের বার-কাম-রেস্তোরাঁগুলোতে। তার ওপর পিকনিক-টিকনিক হুল্লোড়বাজি তো ছিলই।
সোমা টের পাচ্ছিল, বিকাশ তাকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। আপস্টার্ট যুবক-যুবতীদের যে ছাঁচ, নরম মোমের মতো তার ভেতর তাকে ঢেলে অন্যরকম একটা আকার দিতে শুরু করেছিল বিকাশ। সোমার ব্লাউজের ঝুল ছোট হতে হতে আট ইঞ্চিতে ঠেকেছিল, হাতা অদৃশ্য হয়ে স্লিভলেস হয়ে গিয়েছিল। তখন তার ঠোঁট রঞ্জিত, নখ ম্যানিকিওর কথা। চুলে শ্যাম্পু, চোখে চাকার মতো গোল চশমা এবং নাভি পর্যন্ত পেট উন্মুক্ত হয়ে গেছে। রেস্তোরাঁয় বসে এক-আধদিন বিকাশ এবং অন্য বন্ধুদের সঙ্গে বিয়ার কি শেরি খেয়ে দেখেছে সে। তবে রুবিদের মতো পাঁড় মাতাল হয়ে উঠতে পারেনি। সোমা টের পাচ্ছিল কিন্তু কিছু করার ছিল না; পাহাড়ের ঢালে এক টুকরো পাথরের মত সে দ্রুত অতলে নেমে যাচ্ছিল।
এর মধ্যে বছর দেড়েকের মতো কেটে গেছে। এম.এ পাশ করে গিয়েছিল সোমা। তারপরও কলকাতাতেই থেকে গেছে। বিকাশদের সঙ্গে আলাপ-টালাপ হবার পর লক্ষ্ণৌতে বিশেষ যেত না সে। দশবার যাবার তাড়া দিলে একবার হয়তো যেত। কলকাতা নামে এই শহর জাদুকরের মতো তখন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
এম.এ. পাশ করায় সোমার হাতে প্রচুর সময়। তখন বিকাশের সঙ্গে দারুণ ঘুরছে সে। কোনও কোনও দিন ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত, এক আধদিন ফিরতই না। এই নিয়ে হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে রোজ কথা-কাটাকাটি, রোজ ঝগড়া। বাড়ি থেকেও ফিরে যাবার জন্য চিঠি আসছিল। বাবা ছেলে দেখছেন, সোমার বিয়ে দিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে চান। সোমার তখন কোনওদিকেই চোখ ছিল না।
মনে আছে এই সময় বিকাশ অফিস থেকে কদিনের ছুটি পেয়েছিল। ছুটিটা কাটাবার জন্য সে গিয়েছিল দার্জিলিং, সঙ্গে সোমা। দার্জিলিং থেকে ফেরার তিন মাস পরেই সেই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা সোমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, সে প্রেগনেন্ট। উঠতে-বসতে-চলতে ফিরতে নিজের দেহের মধ্যে আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব সে টের পেতে লাগল। ভীত বিমূঢ় সোমা বিকাশকে বলেছিল, আমার কী হবে?
সব শুনে শার্ট থেকে টোকা দিয়ে ধুলো ঝাড়ার মতো বিকাশ বলেছিল, ম্যাটার অফ ফাইভ মিনিটস। তোমাকে কালই একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। সে তোমাকে ফ্রি করে দেবে।
কিন্তু
কী?
চোখ-কান বুজে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার মতন সোমা বলেছিল, তুমি আমাকে বিয়ে করো।
বিয়ে! এমন একটা অদ্ভুত ভীতিকর শব্দ আগে আর যেন শোনেনি বিকাশ। সে বলেছিল, এই সামান্য ব্যাপারের জন্যে বিয়ে! জানোনা, রুবি দুবার অ্যাবরসান করিয়েছে, ইন্দ্রাণী একবার। করবী-হেমারা কতবার ডাক্তারের কাছে গেছে হিসেব নেই। ইটস এ শর্ট অফ এনজয়মেন্ট। বিয়ে করে এর মধ্যেই ফেঁসে যেতে চাই না। ডাক্তার-ফাত্তার ওষুধ-টোষুধের ব্যবস্থা থাকতে কে ওসব ঝামেলায় যায়। কালই তোমাকে আবার পবিত্র কুমারী করে দিচ্ছি।