আমার কোন কথা?
এই তোমার ফ্যামিলির, তোমার অ্যাম্বিসনের, তোমার ভবিষ্যতের।
সোমা তাদের ফ্যামিলির কথা বলেছিল। অ্যাম্বিসান সম্বন্ধে ভাষা-ভাষা উত্তর দিয়েছিল। আর ভবিষ্যৎ? এ ব্যাপারে তখন তেমন কিছু ভাবেনি সে।
বিকাশও তার সব কথাই বলেছিল। তার বাবা রেয়ার প্রিশিসান মেশিনারির ইমপোর্ট লাইসেন্স পেয়ে কিছু টাকা পয়সা করেছেন, নিউ আলিপুরে তাদের নতুন বাড়ি হয়েছে, বিকাশের ভাই বোন কেউ নেই, সে একা। জীবনে তার বিরাট উচ্চাশা; কিছুদিন এখানে চাকরি-বাকরি করে কোম্পানির পয়সায় সে আমেরিকায় যাবে; ওখানে রিসার্চ করবার খুব ইচ্ছা; ফিরে এসে একটা কারখানা খুলবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
গল্পে গল্পে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। পুকুরের ওপারে একটা ঘর থেকে খাবারের সুঘ্রাণ ভেসে আসছিল। বাবুর্চি-টাবুর্চি নিয়ে আসা হয়েছে, তারাই ওখানে রান্না-বান্না করছিল।
এই সময় একটি যুবক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছিল খাবার রেডি, এবার সবাই স্নান করে নাও তারপরেই দেখা গেল, ঝোপঝাড় থেকে গাছতলা থেকে যুবক-যুবতীরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসে ডাইভিং বোর্ডের ওপাশের ঘরে ছুটল। একটু পর সুইমিং কস্টিউম পরে যখন ওরা বেরিয়ে এসে জলে ঝাঁপ দিল, সে দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে পারছিল না সোমা।
বিকাশ বলল, চলো, স্নান করি
সোমা মাথা নাড়ল, আমি স্নান করে এসেছি। তাছাড়া সাঁতার জানি না। পুকুরে কখনও নামিনি।
উৎসাহের গলায় বিকাশ বলল, তা হলে তো নামতেই হয়; একস্ট্রা কস্টিউম নিশ্চয়ই দু-একটা পাওয়া যাবে। চলো, তোমাকে সাঁতার শেখাই।
জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সোমা বলল, না না, আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি স্নান করে আসুন।
হঠাৎ চোখ গোল করে বিকাশ বলল, এটা কী রকম হল? উই আর ফ্রেন্ডস; একটু আগে জেন্টলম্যানস এগ্রিমেন্ট হল, আমরা তুমি করে বলব। অথচ তুমি এখনও আপনি করে চালাচ্ছ!
একদিনে কি আর তুমি বলতে পারব! ওর জন্যে সময় লাগবে।
তোমার বন্ধু রুবি কিন্তু প্রথম দিনই বলেছিল।
আমি যে রুবি নই।
একপলক সোমাকে দেখে নিয়ে বিকাশ বলেছিল, তা ঠিক; তুমি ডিফারেন্ট। বলেই সে টয়লেটের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে জলে ঝাঁপ দিল। তারপর বদ্ধ জলাশয়ে মাছের মতো যুবক-যুবতীরা যেভাবে খেলতে লাগল, তেমন খেলার দৃশ্য আগে আর কখনও দ্যাখেনি সোমা।
স্নানের পর হইচই করে খাওয়া-দাওয়া। তারপর সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাছতলায় অনেকক্ষণ গড়িয়ে নিল। রোদের রঙ যখন হলুদ হয়ে এল, সেইসময় রুবি বলল, এবার একটু গান-টান হোক–
গ্র্যান্ড আইডিয়া! লোকসভায় প্রস্তাব পাস করার মতো সবাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সায় দিল।
বিকাশ হঠাৎ বলে উঠল, আমার একটা বক্তব্য আছে। আমাদের নিউ ফ্রেন্ড, মানে সোমা আজ গান-টান গেয়ে কিংবা বাজিয়ে কিংবা নেচে আমাদের আনন্দ বর্ধন করবে।
লাভলি প্রোপোজাল। আমরা হোল-হার্টেডুলি সমর্থন করছি।
বিব্রতভাবে চারদিকে তাকিয়ে সোমা বলল, দেখুন, আমি নাচ-গান-টান কিছু জানি না। ম্যাক্সিমাম একটা আবৃত্তি করতে পারি।
একটা ছেলে ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, আবৃত্তি! মানে রেসিটেসন। কী রিসাইট করতে চান?
রবীন্দ্রনাথের কোনও কবিতা।
রবীন্দ্রনাথ? দেখুন ওই মানুষটার ওপর আমাদের সবার দারুণ শ্রদ্ধা, কিন্তু আমাদের গেট-টুগেদারে রবীন্দ্রনাথকে টানাটানি না করাই ভালো। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা লাইট; হুল্লোড়বাজি আর কী। তার ভেতর গুরুগম্ভীর জিনিস ঢোকালে আনন্দটাই নষ্ট। আপনি বরং আজ আমাদের পারফর্মেন্স দেখুন। পরে আরেক দিন পার্টিসিপেট করবেন।
মনে মনে ছেলেটাকে হাজারটা ধন্যবাদ দিল সোমা। মুখে বলল, সেই ভালো।
একটি মেয়ে তার নাম ইন্দ্রাণী, বলল, তা হলে বিকাশ, তোমার পপ গান দিয়েই আজ শুভারম্ভ হোক–
ইজিলি, বিকাশ উঠে দাঁড়াল। তারপর দুহাত সামনে ছড়িয়ে দিয়ে শুরু করল, মাই ডার্লিং–মাই ডালিং, কেম ডাউন ফ্রম দা সিলভারি মুন–রাম্বা–রাম্বা–
আরেকটি ছেলে স্প্যানিশ গিটার বাজিয়ে বিকাশকে সাহায্য করতে লাগল।
পর পর আটটা গান গাইল বিকাশ। তার গলা বেশ ভালোই, সুরেলা। বিকাশের গানের পর রুবিরা কটি মেয়ে এবং কটা ছেলে টুইস্ট আর চা-চা-চা নাচল।
তারপর শুরু হল ফোটো ভোলা। চারধারে শুধু ক্লিক-ক্লিক-ক্লিক। সব চাইতে বেশি ফোটো তুলেছিল বিকাশ, তার সাবজেক্ট একটাই–সে হল সোমা। সোমার ফোটো তুলে তুলেই সে ফিল্ম শেষ করে ফেলেছে। ছবি তোলার পর সবাই ড্রিঙ্ক করল।
সন্ধের পর ওরা কলকাতায় ফিরে এসেছিল। এমন কী মেয়েরাও। রুবি তো ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই গেল। সোমাকে সবাই অনুরোধ করেছিল। হাতজোড় করে সে কোনওরকমে আত্মরক্ষা করেছে। এক গাড়িতে রুবি, বিকাশ, ইন্দ্রাণী, পল্লব আর সোমা। গাড়িটা বিকাশের; সে-ই চালাচ্ছিল। তার পাশে সোমা, তারপর রুবি। সোমা অন্যমনস্কর মতো সারা দিনটার কথাই ভাবছিল। ফ্রি মিক্সিং বলে একটা শব্দ আছে, এই কি তার নমুনা?
হঠাৎ পাশ থেকে রুবি বলে উঠেছিল, আজকের দিনটা কী রকম লাগল, সোমা?
সোমা বলেছিল, ইন্টারেস্টিং; দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হল।
তুই তো আসতেই চাইছিলি না।
সোমা উত্তর দ্যায়নি।
বিকাশ ওধার থেকে বলেছিল, মাঝে মাঝেই আমরা এই রকম মিলে মিশে একটু আধটু আনন্দ করি। এবার থেকে সব গেট-টুগেদারে তোমাকে চাই কিন্তু।