সকালে।
ফিরবি কখন?
আগে তো যাই; তারপর ফেরার কথা।
আর কে কে যাচ্ছে?
এই আমাদের কজন বন্ধু-টন্ধু ক্লাসের কটি মেয়ের নাম করছিল রুবি। তারপর বলেছিল, তাছাড়া বাইরেরও আছে।
তপতী জিগ্যেস করেছিল, বাইরের কারা?
সে আছে, তুই চিনবি না।
পিকনিকটা পুরোপুরি মেয়েদেরই তো?
রুবি থমকে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থেকে আচমকা শব্দ করে হেসে উঠেছিল, হাসতে হাসতে তার পেটে খিচ ধরে যাচ্ছিল যেন। এমন অদ্ভুত মজার কথা আগে আর কখনও শোনেনি সে।
বিমূঢ়ের মতো সোমা বলেছিল, হাসছিস যে?
হাসব না তো কী! তুই কোন যুগের মেয়ে রে?
সোমা থতিয়ে গিয়েছিল, না, মানে—
মানে-টানে থাক; এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো কুড়িটা টাকা চাঁদা বার কর তো৷
সেই রবিবারই ব্যারাকপুর গিয়েছিল সোমা। সেখানে গিয়ে দ্যাখে অনেক যুবক-যুবতী আগেই এসে গেছে। মেয়েদের চাইতে ছেলেদের ভিড়ই বেশি।
ক্লাসের কটি বন্ধু ছাড়া অন্য ছেলে মেয়েরা তার অচেনা। মেয়েগুলোর সাজসজ্জা রুবির মতোই। ফাঁপানো চুল রাঙানো নখ, আধখোলা শরীর। ছেলেদের টাইট লো-কাট ট্রাউজার আর জ্যাকেট কিংবা শার্কস্কিনের কলারওলা পাঞ্জাবি। কঁধ পর্যন্ত নেমে আসা হিপি-মার্কা চুল, মোটা লম্বা জুলপি। কারো কাঁধে ক্যামেরা, কারো ট্রানজিস্টার। দেখতে দেখতে সোমার মনে হতে লাগল, এই যুবক-যুবতীরা নতুন অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটি থেকেই বুঝিবা উঠে এসেছে।
কবি সবার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল, হিয়ার ইজ আওয়ার নিউ ফ্রেন্ড সোমা, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর যাদের সঙ্গে পরিচয় করানো হল তাদের এক গাদা নাম বলে গেছে রুবি, এ হল পল্লব, এ সোনিয়া, এ জয়া, এ বিপ্লব, এ সোমনাথ, এ ইন্দ্রাণী, এ হল বরুণ
সবার শেষে রুবি যার নাম করেছিল সে বিকাশ, বিকাশ মিত্র। এতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে সে-ই সব চাইতে স্মার্ট, সব চাইতে ঝকঝকে, সব চাইতে ফর্সা। তার দিকে তাকিয়ে সোমার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল।
রুবি বলেছিল, এ হল বিকাশ, আওয়ার ওল্ড প্যাল। এ বছর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। আর হয়েই দারুণ একখানা চাকরি বাগিয়ে ফেলেছে। স্টার্টিংয়ের দেড় হাজার টাকা। দু-এক বছরের ভেতর ওদের কোম্পানি ওকে আমেরিকা-টামেরিকা পাঠিয়ে দেবে।
রুবি সমানে বকে যাচ্ছিল; সোমা কিন্তু বিশেষ শুনছিল-টুনছিল না। বিকাশের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল সে।
এদিকে পরিচয়-টরিচয় হয়ে যাবার পর সোমা দুহাত জোড়া করতে যাচ্ছিল, তার আগেই নিজের হাত বাড়িয়ে সোমার একটা হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলেছিল বিকাশ, সো গ্ল্যাড টু মিট ইউ। নাই উই আর অল ফ্রেন্ডস, আমি কিন্তু তোমাকে আপনি-টাপনি করে বলতে পারব না। অ্যান্ড আই উইল এক্সপেক্ট, তুমিও আমাদের তুমি করেই বলবে।
রুবি সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়েছিল, ও সিওর, সিওর। সোমা উত্তর দেয়নি।
রুবি আবার বলেছিল, বুঝলে বিকাশ, আমার এই বন্ধুটা দারুণ শাই। ভেবেছিলাম আমিই ওকে মানুষ-টানুষ করব। কিন্তু এ ব্যাপারে তোমার এফিসিয়েন্সি আমার চেয়ে অনেক বেশি। তুমিই ওর দায়িত্ব নাও।
বিকাশ দুই হাত দুদিকে ছড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, মোস্ট গ্ল্যাডলি।
তোমরা কথাবার্তা বলো; আমি পল্লবের কাছে যাই। দূরে আঁকড়া-মাথা প্রকাণ্ড জামরুল গাছের তলায় যে যুবকটি ট্রানজিস্টর শুনছিল, প্রায় উড়তে উড়তে তার কাছে চলে গিয়েছিল রুবি।
একটু চুপ করে থেকে বিকাশ বলেছিল, চলো, কোথাও বসি; তোমার সঙ্গে জমিয়ে খানিকটা আড্ডা দেওয়া যাক।
সোমার আপত্তি ছিল না, এমন অসঙ্কোচ স্মার্ট ছেলে আগে আর কখনও দ্যাখেনি সে। বেশ ভালোই লাগছিল, আর পায়ের তলার স্রোতের টান অনুভব করছিল সোমা।
একটা পছন্দমতো জায়গার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল বিকাশ। চারধারে গাছপালা, মাধবীলতার, ঝোপ, ঝোপগুলোর ভেতর সিমেন্টের বেঞ্চ, সেগুলোর মাথায় লাল-নীল ছাতা; সেই দিনটার জন্য ওই ছাতাগুলো লাগানো হয়েছিল। মাঝখানে প্রকাণ্ড লম্বাটে দীঘি, এক দিকে সানবাঁধানো লাল ঘাট, আরেক দিকে ডাইভিং বোর্ড। বোর্ডটার ওপাশে পোশাক বদলাবার জন্য দুটো বড় ঘর। একটু পুরুষদের জন্য, অন্যটা মেয়েদের।
দেখতে দেখতে দীঘির দক্ষিণ প্রান্তে একটা ছায়াচ্ছন্ন নির্জন ঝোপ চোখে পড়েছিল বিকাশের। সে চেঁচিয়ে উঠেছিল, গ্র্যান্ড, চলো, ওখানে গিয়ে বসি।
ঝোপটার দিকে যেতে যেতে সোমা লক্ষ্য করছিল, মাধবীলতার ঝাড়গুলোর কিংবা বড় বড় গাছের তলায় জোড়া জোড়া যুবক-যুবতী বসে আছে। অনেকে আবার দলবদ্ধভাবে পুকুরপাড়ের সরু নুড়ি বিছানো রাস্তায় ঘুরছিল, অনেক আড্ডা দিতে দিতে হুল্লোড় করছিল।
ওরা যখন পাশাপাশি হাঁটছিল, তখন আশপাশ থেকে নানারকম মন্তব্য ভেসে আসছিল, চিয়ার ইউ লাকি ডগ–কিংবা উইশ ইউ বেস্ট অফ লাক
হেসে হেসে সবার উদ্দেশ্যেই বিকাশ বলছিল, থ্যাঙ্কস্থ্যাঙ্কস্থ্যাঙ্কস্
কেউ কেউ আবার চোখ টিপে ইঙ্গিত করছিল। মন্তব্যগুলোয় কিংবা চোখের ইশারায় না বুঝবার কিছু ছিল না। সোমার কান গরম হয়ে উঠছিল, চোখ মুখ আঁ আঁ করছিল। তার ভেতরেই দীঘিপারের ঝোপে গিয়ে বসে ছিল।
সোমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে বিকাশ বলেছিল, আমার কিউরিসিটির প্রায় ফেমিনিন বলতে পারো। এখন তোমার কথা বলো–ডিটেলস চাই, কিছু বাদ দেবে না।