সোমেশের মা নিজের হাতে দুটো ছোট টেবিল টেনে এনে তপতীদের সামনে রাখতে রাখতে চাকরদের বললেন, এখানে প্লেটগুলো দে
খাবার দেখেই আদুরে কিশোরীর মতো নাকে কাঁদতে শুরু করল তপতী, এত কখনো খাওয়া যায়?
সোমেশের মা বললেন, নিশ্চয়ই খাওয়া যায়, তোদর বয়সটাই তো খাবার বয়স। যা হাতে করে দেব লক্ষ্মীমেয়ের মতো খেয়ে নিবি। কখনও ধমকে কখনও পিঠে হাত বুলিয়ে তিনি তপতীকে খাওয়াতে লাগলেন। বলতে লাগলেন, কলকাতার হস্টেলে কী যে খাস, তুই-ই জানিস। ছমাস আগে দেখেছিলাম, তখনও কী সুন্দর চেহারা। আর এখন কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে পড়েছে, গায়ের রঙ কালি। দাঁড়াও তোমাকে একবার হাতে পাই–
আরো কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে তপতীরা উঠে পড়ল। সোমেশের বাবা-মা বারবার বলে দিলেন বিয়ের সময় সোমা যেন নিশ্চয়ই আসে; আগে থেকেই তারা নিমন্ত্রণ করে রাখলেন। তারপর ওঁরা দুজনেই ভারী শরীর নিয়ে গেট পর্যন্ত তপতীদের এগিয়ে দিয়ে গেলেন।
রাস্তায় বেরিয়ে তপতী বলল, আমার শশুর বাড়ি কেমন দেখলি বল—
সোমা বলল, খুব ভালো।
আর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি?
চমৎকার। তোকে দারুণ ভালোবাসে।
সবই ভালো। তবে–মুখ কাচুমাচু করে কপট ভয়ের গলায় তপতী বলল, এই শাশুড়ির পাল্লায় পড়লে খেয়ে খেয়েই আমি মরে যাব।
তপতীকে কত উজ্জ্বল, সুখী এবং পরিতৃপ্ত দেখাচ্ছে। হঠাৎ ভীষণ ঈর্ষা হতে লাগল সোমার। এমন একটা সুখের ঘরে সে-ও তো আসতে পারত। কিন্তু সেই লোকটা? স্মৃতির অতল থেকে উগ্র দুর্গন্ধের মতো উঠে এল বিকাশ। সেই পুরোনো বিষাদটা আবার যেন চারদিক থেকে জাল ছোট করে এনে তাকে ঘিরে ফেলতে লাগল।
অন্যমনস্কর মতো তপতীর সঙ্গে টাঙ্গায় ফিরে এল সোমা। টাঙ্গাওলার পাশ থেকে মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, গেলি পাঁচ মিনিটের জন্যে এলি তিন ঘণ্টা কাটিয়ে। বুড়োবুড়ির সঙ্গে কী এত গল্প করছিলি?
সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। যখন সোমেশদের বাড়ি যায় তখনও চারদিকে রোদের ছড়াছড়ি। কিন্তু এখন দিনের আলো বলতে কোথাও কিছু নেই, অন্ধকারে আলোটা ঝাপসা। একটা দুটো করে তারা ফুটছে। রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির বাতিগুলো চোখ মেলতে শুরু করেছে।
তপতী বলল, এই কত রকম–
মৃন্ময় বলল, বুড়োবুড়ির সঙ্গে এতক্ষণ কাটালি; সোমেশ থাকলে দেখছি গল্পে গল্পে রাত কাবারই করে ফেলতিস।
সে যে একটা কলেজের অধ্যাপিকা, তপতীর মনে রইল না। চপলা বালিকার মতো সে জিভ ভ্যাংচাল, এ-হে-হে, তোমায় বলেছে–
টাঙ্গা চলতে শুরু করেছিল। মৃন্ময় বলল, এখনই বাড়ি ফিরে কী হবে। চল কাপ্তান পুল পর্যন্ত ঘুরে আসি। একটু পর পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে। যা লাভলি লাগবে না
তপতী উৎসাহের গলায় বলল, তাই চলো।
টাঙ্গা লাইন বাজার ধরে কাপ্তান পুলের দিকে চলল। মৃন্ময় এবার সোমাকে বলল, তপীর শ্বশুর-শাশুড়িকে কী রকম দেখলেন ম্যাডাম? জোড়া বিন্ধ্য পর্বত, না? কার্টুনের এমন সাবজেক্ট আর হয় না–
সোমা উত্তর দিল না।
আর যেন কী একটা বলল মৃন্ময়, সোমা এবার আর শুনতে পেল না। কাপ্তান পুলের দিকে যেতে যেতে রুপোর আলোর মতো চাঁদটা কখন দিগন্তের তলা থেকে উঠে এল, কখন লাইন বাজার পার হয়ে দুধারে ধু-ধু মাঠ আর বিল আর ঝোপছাপ গাছপালা কুয়াশার আবছা হয়ে যেতে লাগল, কখন দক্ষিণ দিক থেকে ঝিরঝিরে স্নিগ্ধ বাতাস ছাড়ল সোমা জানে না। সেই লোকটা যার নাম বিকাশ, বিকাশ মিত্র এখন তার অস্তিত্ব জুড়ে একটা দুর্গন্ধময় কদর্য মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
.
বিকাশকে প্রথম দেখেছিল কবে? স্পষ্ট মনে আছে, বছর পাঁচেক আগে— এক পিকনিকে।
লক্ষ্ণৌ থেকে সে বছরই প্রথম কলকাতায় এসেছে সোমা। সেন্ট্রাল ক্যালকাটার এক হস্টেলে থাকত আর ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করত। ইউনিভার্সিটি আর হস্টেল ছাড়া জটিল অরণ্যের মতো এই বিশাল শহরের প্রায় সবটুকুই তার অচেনা। অবশ্য ছুটিছাটায় কিংবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দু-একটা সিনেমা-টিনেমা দেখত। উত্তরে শ্যামবাজার, দক্ষিণে চৌরঙ্গি–তার কলকাতা এইটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
ফিফথ ইয়ারের শেষাশেষি ক্লাসের এক বন্ধু, রুবি-রুবি দত্ত, দারুণ আপস্টার্ট, ঠোঁটে নখে টকটকে রঙ, গায়ে আট ইঞ্চি ঝুলের স্লিভলেশ ব্লাউজ–আঁকা চোখে চাকার মতো প্রকাণ্ড গগস, উন্মক্ত ঘাড় পেট এবং বুকের অনেকটা–একদিন বলল, এই সোমা, আসছে রোববার আমাদের সঙ্গে বেড়াতে যাবি।
কলকাতার মেয়ে বলেই হয়তো, কিংবা নিজের স্বভাবের মধ্যেই স্নিগ্ধ অনুদ্ধত একটি চিরকালের বাঙালি মেয়ে আছে বলেই কিনা, রুবিকে খুব একটা পছন্দ করত না সোমা। অথচ এই মেয়েটা সম্বন্ধে তার দুরন্ত আকর্ষণও ছিল। কেন ছিল, সে বুঝিয়ে বলতে পারবে না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনুভূতির। সোমা বলেছিল, কোথায়?
পিকনিকে।
পিকনিকটা কলকাতাতেই হবে?
আরে না, কলকাতায় পিকনিক করে মজা আছে নাকি? তার চাইতে ভালো একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে এলেই হয়। ঠিক করেছি ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে একটা বড় বাগানবাড়ি নেব
সে এখান থেকে কতদুর?
কাছেই। এতদিন কলকাতায় এসেছিস, শহরটা ভালো করে দেখলিই না; কারো সঙ্গে মেলামেশাও করিস না। একেবারে পল্লীবালার মতো ঘরের কোণে আটকে আছিস। তোকে মানুষ করতে হবে দেখছি।
ভয়ে ভয়ে সোমা জিগ্যেস করেছিল, কখন যেতে হবে?