বন্ধুকে একলা পেয়ে সোমা যখন কিছু বলতে যাবে সেই সময় ওরা একটা বড় দোতলা বাড়ির সামনে এসে গেছে। কাঠের গেট খুলতে খুলতে তপতী বলল, আর মাস ছয়েক পর পুর্ণিয়া এলে তুই গোলাপ বাড়িতে উঠতিস না, তোকে এখানে এনেই তুলতাম।
তার মানে?
আলতো করে সোমার কাঁধে একটা টোকা দিয়ে তপতী বলল, এক নম্বরের হাঁদারাম তুই, মাথায় তোর কিছু নেই।
বিদ্যুৎ চমকের মতো কী একটা আভাস পেয়ে গেল সোমা। বলল, তা হলে কি এটা তোর
ভাবী শ্বশুর বাড়ি।
এই দারুণ জিনিসটা দেখবার কথাই তখন বলেছিলি?
ইয়েস ফ্রেন্ড।
সোমেশ তাহলে—
নিজের বুকে একটা আঙুল রেখে তপতী বলল, আমার হৃদয়েশ্বর।
তিন বছর একসঙ্গে আছি; এই সুখবরটা তো আগে দিসনি—
ভেবেছিলাম, পূর্ণিয়ায় এনে তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব।
সোমা খুব আগ্রহের গলায় বলল, দারুণ সারপ্রাইজ দিয়েছিস। এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে তোর প্রাণেশ্বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে–
দুহাতের সবগুলো আঙুল এবং মাথা একসঙ্গে নেড়ে তপতী বলল, ওটি পারব না।
কেন?
প্রভু এখন ইন্ডিয়ার বাইরে; আমেরিকায় রিসার্চ করছেন।
তোদের কদ্দিনের আলাপ?
সেই ছেলেবেলা থেকে। এক শহরেরই ছেলে মেয়ে আমরা।
সোমা হাসল, বেশ দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার।
তপতীও হাসল, যা বলেছিস।
হঠাৎ কী মনে পড়তে সোমা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বুড়োবুড়ি মানে তোর শ্বশুর শাশুড়ী মৃন্ময়বাবুকে দেখলে খেপে যাবে কেন?
আর বলিস না, মৃন্ময়দাটা মহা ফাজিল। বুড়োবুড়ির বিদঘুঁটে কাটুন এঁকে একবার উপহার দিয়েছিল, তাতেই চটে আছে।
সোমা কিছু বলল না। মৃন্ময় সম্বন্ধে তার বিরক্তি আরেকটু বাড়ল শুধু। দুটি বৃদ্ধ মানুষকে নিয়ে যে এমন অসভ্যতা করতে পারে সে যে কতখানি ইতর, বলে না দিলেও চলে।
গেটের পর অনেকখানি খোলামেলা জায়গা। একধারে ছোটখাটো বাগান; আরেকধারে কুয়োতলা, ঘাসের জমি। মাঝখান দিয়ে শুরকির রাস্তা।
কথা বলতে বলতে ওরা গাড়িবারান্দার নীচে এসে পড়ল। একটা মধ্যবয়সি হিন্দুস্থানি চাকর খুব পুরোনো মডেলের একটা ফোর্ড গাড়ি ঝাড়ামোছা করছিল। তপতীকে দেখে বালকের মতন আনন্দে সে প্রায় লাফিয়ে উঠল, আরে দিদিমণি, আপ কব আগয়ী?
আজই। তপতী হাসল।
আইয়ে আইয়ে, বলেই সে ভেতর দিকে খবর দিতে ছুটল।
তপতী দাঁড়াল না, সোমাকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকে দোতলায় উঠে এল। আর উঠতেই দেখা গেল সিঁড়ির মুখে একটি বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনেই প্রচণ্ড মোটা; দেখেই টের পাওয়া যায় তাদের রাতের শরীর। এখন বেশ গরম পড়ে গেছে। তবু দুজনের পায়ে পুরু মোজা, গলায় কম্ফোটার। হয়তো ওঁরা শীতকাতুরে, কিংবা একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়। তাই চারদিকে দুর্গ সাজিয়ে রেখেছেন। সোমা অনুমান করল, এঁরাই তপতীর ভাবী শ্বশুর-শাশুড়ি। দারুণ মোটা বলেই হয়তো এঁদের নিয়ে কার্টুন এঁকেছে মৃন্ময়।
বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার পিছনে গন্ডাদুয়েক ঠাকুর-চাকর দাঁড়িয়ে ছিল। তপতীকে দেখে তারা ভারি খুশি, তাদের চোখে হাসি ছলকে ছলকে যাচ্ছে।
তপতী বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে প্রণাম করল; দেখাদেখি সোমাও। স্নেহময় উজ্জ্বল চোখে বৃদ্ধা বললেন, এই মেয়েটি কে রে তপতী? আগে তো দেখিনি।
সোমার পরিচয় দিল তপতী। এবার বৃদ্ধ বললেন, সোমা মা, তপতীর সঙ্গে তুমি আমাদের বাড়ি এসেছ, খুব খুশি হয়েছি। চল ভেতরে গিয়ে বসি।
বৃদ্ধা এবং বৃদ্ধা ওদের নিয়ে সামনের একটা ঘরে এলেন। তপতীদের সোফায় বসিয়ে পুরু গদিওলা দুটো ইজিচেয়ারে তারা প্রায় শুয়েই পড়লেন। সিঁড়ির মুখ থেকে ঘর পর্যন্ত আসতে দুজনেই ক্লান্ত হয়ে গেছেন; বড় বড় শ্বাস পড়ছে। কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে বৃদ্ধ তপতীর খবর নিলেন। কবে এসেছে, কদিনের ছুটি, কেমন আছে, এতদিন আসেনি কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তারপর বৃদ্ধা বললেন, সোমেশ তোকে এর মধ্যে চিঠিপত্র দিয়েছে?
সোমা অনুমান করল, ছেলেবেলা থেকে দেখছেন বলেই ওঁরা তপতীকে তুই করে বলে।
তপতী রক্তাক্ত মুখ নীচু করে বসে থাকল।
বৃদ্ধা বললেন, তুমি না আজকালকার মেয়ে; অত লজ্জা কীসের?
মৃদু গলায় তপতী বলল, মাসখানেক আগে একটা পেয়েছিলাম।
কাল সোমেশের চিঠি এসেছে। তুইও নিশ্চয়ই পাবি। খুব সুখবর আছে।
দ্রুত মুখ তুলেই নামিয়ে নিল তপতী; তার চোখ আগ্রহে ঝকমক করছে।
বৃদ্ধ বললেন, সোমেশ ডক্টরেট পেয়ে গেছে; মাস তিনেকের মধ্যেই ফিরছে।
তপতী এবারও কিছু বলল না। পাশ থেকে সোমা লক্ষ্য করল তপতীর চোখ মুখ সারা গায়ে আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ছে।
সোমেশের মা বললেন, সোমেশ এলে আমি কিন্তু আর কোনও কথা শুনব না। প্রথম যে তারিখটা পাব সেদিনই দুই হাত এক করে দেব। এখন তো তেমন জোর নেই কিন্তু বিয়েটা হয়ে যাক, কলকাতায় পড়ে থাকা চলবে না।
সোমেশের বাবা বললেন, কলেজের চাকরিটা ছেড়ে দিতে হবে। আমার একটা ছেলের বউ, সে চোখের আড়ালে দূরে দূরে থাকবে, সেটি হবে না। ছেলেকেও জানিয়ে দিয়েছি, ডক্টরেট হও আর যা-ই হও, চাকরির জন্যে দিল্লি-কলকাতা-বোম্বাই যেতে পারবে না, পুর্ণিয়াতেই যা পাও জুটিয়ে নিতে হবে। বেশি টাকা আমাদের দরকার নেই।
সোমেশের মা বললেন, এই বুড়ো বয়সে ছেলে ছেলের বউকে ছেড়ে থাকতে পারব না বাপু। বলতে বলতে হাতের ভর দিয়ে উঠে বাইরে চলে গেলেন।
একটু পর যখন ফিরে এলেন সঙ্গে দুটো চাকর। তাদের হাতে নানারকমকের প্লেটে রাজ্যের খাবার।