লাজুক হাসল তপতী। আরক্ত মুখে বলল, তোমাকে আমি বলেছি!
মৃন্ময় বলল, মুখ ফুটে না বললে কী আর বোঝা যায় না? ওখানে যাবার জন্যে তো মুখিয়েই আছিস।
আমি কিন্তু কিছুতেই খাদাঞ্চি যাব না।
যাবি যাবি, হাজারবার যাবি। নাকের ডগায় বঁড়শি আটকানো আছে, না গিয়ে কি পারবি? এখন না গেলেও লুকিয়ে চুরিয়ে তো যাবিই–
মৃন্ময় কোচোয়ানকে বলল, খাদাঞ্চি চালাও
সোমা তপতীকে লক্ষ্য করছিল। তিন বছর ধরে সে দেখছে, তপতীটা দারুণ হুল্লোড়বাজ। লজ্জা-টা বলে কিছু নেই। কিন্তু খাদাঞ্চি যাবার কথায় তার মুখে রক্তোচ্ছাস খেলে যাচ্ছে। অবাক সোমা খুব নীচু গলায় বলল, খাদাঞ্চি যাবার কথায় একেবারে লজ্জাবতী লতাটি হয়ে গেলি, কী ব্যাপার রে?
চকিতে মৃন্ময়কে দেখে নিয়ে গলার স্বর অতলে নামাল তপতী, একটা দারুণ জিনিস দেখাব বলেছিলাম না? সে জিনিসটা ওই খাদাঞ্চিতেই আছে।
জিনিসটা কী রে?
গেলেই দেখতে পাবি। একখানা বা সারপ্রাইজ দেব না।
একটু ভেবে সোমা বলল, টাঙ্গা খাদাঞ্চিতে আসবে তা হলে তুই জানতিস?
নিশ্চয়ই জানতাম। মৃন্ময়দার সঙ্গে যখন বেরিয়েছি তখন সে কি আর ওখানে না গিয়ে ছাড়বে। যা ফাজিল।
এদিকে রাস্তায় যারা যাচ্ছিল তারা প্রায় সবাই মৃন্ময়র্কে ডেকে ডেকে কথা বলছিল। কেমন আছেন মৃন্ময়বাবু? কবে এলেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। মৃন্ময়ও কারোকে কারোকে ডাকছিল, এ বিষুণ, ক্যায়সা হায় রে?
আচ্ছা, বিষুণ নামধারী লোকটা বলে, আপ ক্যায়সা?
বহুত খু— বালবাচ্চা আচ্ছা তো?
জী—
কিংবা এ রামলগন সিং
রামগলন নামধারী লোকটা বলে, আরে বাপ, মিরিনমায়বাবু। (মৃন্ময়বাবু) আপ কব পূর্ণিয়া আয়া?
মৃন্ময় বলে, পরশু রোজ
আরে বাপ পরশু রোজ আয়া, হাম নহী জানে—
জানবি কী করে? দেখা তো হয়নি। এখনও তাড়ি খাস, বউকে পেটাস?
এক হাত জিভ কেটে রামলগন প্রায় আঁতকেই ওঠে, আরে বাপ, দারু-ঊরু কব ছোড় দিয়া
ব্যাটা ধম্মপুত্তুর হয়ে উঠেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
তপতী সোমাকে বলল, মৃন্ময়দা এখানে দারুণ পপুলার। পূর্ণিয়ার এমন কেউ নেই যে তাকে চেনে না। সবার সঙ্গে ওর খাতির।
সোমা কোনওরকম উৎসাহ দেখাল না।
এক সময় বাজার এলাকাটা পিছনে ফেলে টাঙ্গাটা খানিক এগিয়ে বাঁ-ধারে ঘুরল; শিরদাঁড়ার মতো সোজা একটা রাস্তা এখান থেকে পুবে গেছে। দুধারে বাড়িঘর বেশির ভাগই টিনের চালের, মাঝে-মধ্যে পুরোনো আমলের কিছু একতলা। আচমকা বিশাল কম্পাউন্ডওলা একটা তিনতলাও চোখে পড়ল।
রাস্তায় ভিড়-টিড় বিশেষ নেই, দু-চারটে সাইকেল-রিকশা হুস হুস বেরিয়ে যাচ্ছে, কদাচিৎ এক-আধটা টাঙ্গা। কলকাতার হইচই, ট্রাফিক আর জনস্রোতের কথা মনে পড়ল সোমার। সর্বক্ষণ ফুটন্ত টগবগে সেই শহরটির তুলনায় এ শহর কত নির্জন, কত স্তিমিত আর নিরুত্তেজ। সোমার স্নায়ু জুড়িয়ে আসতে লাগল।
রাস্তার লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মুখ ফিরিয়ে মৃন্ময় সোমাকে বলল, এই রাস্তাটা সোজা খাদাঞ্চি আর লাইন বাজার হয়ে হাইওয়েতে মিশেছে।
লোকটাকে কে যে গাইডের ভূমিকা নিতে বলেছে, সে-ই জানে। সোমা উত্তর না দিয়ে উদাসীন গম্ভীর মুখে বসে থাকল।
যাই হোক রাস্তাটা চেনা-চেনা লাগছিল। সোমা তপতীকে আস্তে করে বলল, এই পথটা দিয়ে আজ দুপুরে আমরা তোদের বাড়ি গেছি না?
তপতী উত্তর দেবার আগেই টাঙ্গাওলার পাশ থেকে মৃন্ময় চেঁচিয়ে উঠল, ঠিক ধরেছেন। আপনার মেমারি তো দারুণ শার্প দেখছি; একবার গিয়েই রাস্তাটাকে ঠিক ঠিক মনে করে রেখেছেন। আমার আবার বুঝলেন নিজের মাথাটা দেখিয়ে মৃন্ময় বলল, এটার ভেতর গোবর পোরা। একবারে তো পারবই না সাতবার দেখলেও মনে থাকবে কিনা সন্দেহ।
দাঁতে দাঁত চেপে রইল সোমা। এই গায়ে-পড়া বাজে টাইপের বাঁচাল লোকটাকে অনেক আগেই ঠান্ডা করে দিতে পারত; নেহাত তপতীর দাদা তাই চুপ করে আছে। আরেকটু বাড়াবাড়ি দেখলে নির্ঘাৎ চড় কষিয়ে দেবে।
কিছুক্ষণ যাবার পর ধবধবে সাদা বিরাট একখানা মসজিদ পড়ল, তার কারুকাজ করা গম্বুজে শেষ বেলার আলো এসে পড়েছে। মৃন্ময় বলল, এই মসজিদটার বয়স অনেক। কেউ কেউ বলে সেই নবাবি আমলে তৈরি হয়েছিল।
সোমা উত্তর দিল না।
মসজিদ পেরিয়ে আরো কিছুটা গিয়ে একটা তেরাস্তার মুখে এলে মৃন্ময় হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, এ বগেড়িলাল রুখো–রুখো{ টাঙ্গাওলার নাম বগেছিলাল। টাঙ্গা থেমে গেল।
মৃন্ময় তপতীর দিকে ফিরে ঠোঁট টিপে কৌতুকের গলায় বলল, যা, সোমেশের বাবা-মার সঙ্গে একটু দেখা করে আয়।
মুখ নামিয়ে নখ খুটতে খুটতে তপতী বলল, আজ থাক, পরে একদিন যাব।
না-না, আজই যাব। বুড়োবুড়ি একলা পড়ে থাকে; তুই গেলে খুব খুশি হবে।
তপতী নখ খুঁটতেই থাকল।
এবার আর কৌতুক-টৌতুক না, সস্নেহ কোমল স্বরে মৃন্ময় বলল, যা–যা-তোর বন্ধুকেও নিয়ে যা।
তুমি যাবে না?
না, আমার ওপর বুড়োবুড়ি কেমন চটা জানিস তো; দেখলেই খেপে উঠবে।
তপতী হাসল, খেপবার কাজ করলে খেপবে না?
মৃন্ময় বলল, আচ্ছা তোরা তাড়াতাড়ি ঘুরে-টুরে আয়, আবার জমে যাস না। আমি ততক্ষণ বগেড়িলালের সঙ্গে গল্প করছি।
সোমাকে নিয়ে তপতী নেমে পড়ল। তারপর সে রাস্তাটা সোজা ডানদিকে চলে গেছে সেটা ধরে হাঁটতে লাগল।
একটু আগে মৃন্ময় আর তপতী যা বলছিল তার কিছুই বুঝতে পারছিল না সোমা। মৃন্ময়ের সামনে কিছু জিগ্যেস করতেও তার ইচ্ছা হয়নি, কোন কথায় কী ইতর রসিকতা করে বসবে, লোকটাকে বিশ্বাস নেই।