.
০৬.
ঘুম যখন ভাঙল বিকেলের আলো মলিন হয়ে এসেছে। রোদের রঙ এখন বাসি হলুদের মতন। রাস্তার লম্বা লম্বা গাছগুলোর ছায়া দীর্ঘ হয়ে তপতীদের বাগানে এসে পড়েছে। বাইরে অনেক পাখি ডাকছিল, অজস্র গোলাপের গন্ধে ফাল্গুনের চটুল বাতাস ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে।
বিছানায় শুয়েই বড় বড় জানালার মধ্য দিয়ে আকাশ দেখা যায়। শীতের পর আকাশ এখন ঝকঝকে নীলপালিশ-করা আয়নার মতন।
পাশ ফিরে তপতীকে ডাকতে গিয়ে সোমা দেখল, সে জায়গাটা ফাঁকা। ঘুম ভাঙবার পর কখন সে উঠে গেছে, কে জানে। সোমা শুয়েই থাকল। আকাশ দেখতে লাগল, গাছের ছায়া দেখতে লাগল, পাখিদের চেঁচামেচি শুনতে লাগল। মোটামুটি এসব ভালোই লাগছিল তার, তবু কী রকম এক অন্যমনস্কতা আর বিষাদ যেন তাকে ঘিরে থাকল। একলা হলেই এই বিষাদটা সোমাকে পেয়ে বসে। আর তখনই বিতৃষ্ণার অতল থেকে উঠে এসে সামনে দাঁড়ায় বিকাশ।
হঠাৎ হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল তপতী। এক মুখ হেসে বলল, ঘুম ভেঙেছে তা হলে? আমি তো ভেবেছিলাম আজ আর উঠবি না।
সোমাও হাসল, কিছু বলল না।
তপতী আবার বলল, আর শুয়ে থাকতে হবে না, চটপট উঠে পড়—
মুখ-টুখ ধুয়ে চা খেয়ে রেডি হয়ে নিবি
কী ব্যাপার? হাতের ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসল সোমা।
কী আবার ব্যাপার, এই বিকেলবেলা ঘরে বসে থাকবি নাকি? আমাদের শহরটা কেমন, একটু ঘুরে ফিরে দেখবি না? মৃন্ময়দা টাঙ্গা ডাকতে গেছে। এসেই কী রকম তাড়া লাগায় দেখিস–
মৃন্ময়ের কথায় সোমার মুখে ছায়া পড়ল। বলল, আজই বেরুবি?
তপতী বলল, আজ বেরুলে ক্ষতিটা কী?
না, ক্ষতি কিছু না। সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসেছি, খুব টায়ার্ড লাগছে। এখন আর বেরুতে ইচ্ছে করছে না। মুখটা করুণ করে সোমা তাকাল। প্লিজ, মনে কিছু করিস না ভাই
আচমকা দরজার কাছ থেকে দুম করে কেউ বলল, আপনি একটা ল্যাক্টাভ্যাগাস–
চমকে সেদিকে তাকাল সোমা; দরজার ঠিক ওপরেই মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। সে কখন এসেছে, কে জানে। কতক্ষণ তাদের কথা শুনছে, তাই বা কে বলবে। রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল সোমার।
তপতী বলল, ল্যাক্টাভ্যাগাস–তার মানে কী?
মৃন্ময় বলল, কে জানে কী মানে। বলতে বেশ লাগল তাই বলে ফেললাম।
তপতী বালিকার মতন সারা গা দুলিয়ে হেসে উঠল, তুমি একটা রাবিশ।
মৃন্ময় বলল, ঠিক আছে রাবিশই। এখন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে তোরা। টাঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে।
জাস্ট টেন মিনিট সময় নিচ্ছি।
নো, ফাইভ মিনিট। কাপড়-চোপড় বদলাতে এর চাইতে বেশি সময় লাগে নাকি?
বা রে, চা খাব না?
চা বাইরে কোথাও খেয়ে নেব। মৃন্ময় আর দাঁড়াল না, বড় বড় পা ফেলে চলে গেল।
এই অসভ্য লোকটার সঙ্গ অসহ্য। সোমা বলল, আমি কিন্তু যাব না।
সোমা যে ভেতরে ভেতরে খুবই রেগে গেছে, তপতী লক্ষ্য করেনি। অসহিষ্ণু গলায় সে বলল, দিন দিন বুড়িয়ে যাচ্ছিস, কী যে স্বভাব হচ্ছে তোর। কলকাতায় হোস্টেলের ঘর থেকে বেরুস না; এখানে এসেও যদি ঘরেই বসে থাকবি তবে আসার মানে কী? হাত ধরে এক টানে সোমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে আনল তপতী; তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করল, চল, আজ তোকে একটা দারুণ জিনিস দেখাব। যেভাবে সরলা কিশোরীকে চতুর পুরুষ ফুসলায় তপতীর গলায় স্বর অনেকটা সেই রকম।
সোমা বলল, কী দেখাবি?
সেটা এখন বলব না : ক্রমশ প্রকাশ্য।
সোমা শেষ চেষ্টা করল, কাল দেখলে হত না?
উঁহু আজই–প্রায় টানতে টানতে সোমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল তপতী।
এক কলেজে বছর তিনেক কাজ করছে ওরা। প্রথম দিন থেকেই সোমা দেখছে, মেয়েটা যেন সব সময় টগবগ করে ফুটছে। একটুতেই সে উচ্ছ্বসিত একটুতেই তার মধ্যে ঢেউ ওঠে। আর যখন যেটা মাথায় চাপে সেটা না করে ছাড়ে না। কাজেই তার ইচ্ছায় নিজেকে না সঁপে দিয়ে রেহাই পাওয়া গেল না।
.
শাড়ি বদলাতে বেশিক্ষণ লাগল না। তারপর তপতীরা বেরিয়ে পড়ল। তপতীর মা চা খাবার কথা বলেছিলেন, মৃন্ময় সে সময় দিল না। দোলন ঝুলন যেতে চেয়েছিল; তাদের কী একটা পরীক্ষা সামনে, তাই নেওয়া হল না।
বাড়ি থেকে বেরুলেই দুর্গাবাড়ি। তার গায়েই একটা টাঙ্গা দাঁড়িয়ে ছিল। সোমা আর তপতী পিছনের সিটে বসল। মৃন্ময় বসল সামনের সিটে, কোচোয়ানের পাশে। সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গা চলতে শুরু করল।
একটু পর খোয়ার রাস্তা পেরিয়ে জমজমাট বাজারের কাছে এসে পড়ল টাঙ্গাটা। কলকাতার অনুকরণে এখানে কিছু দোকানপাট-ঘড়ির দোকান, রেডিওর দোকান, রেডিমেড পোশাকের দোকান। কাঁচের শো-উইন্ডোতে জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা রয়েছে। দু-একটা ছোটখাটো রেস্তোরাঁও চোখে পড়ল।
মৃন্ময় সোমাকে বলল, বুঝলেন ম্যাডাম, এটা আমাদের পূর্ণিয়ার চৌরঙ্গী।
সোমা অন্যদিকে ফিরিয়ে থাকল।
মৃন্ময়ের হয়তো দুকান কাটা, সে বলতে লাগল, কলকাতার তুলনায় অবশ্য কিছুই না; তবু নিজেগুণে ক্ষমা করে নেবেন।
সোমা চুপ। মৃন্ময় এবার তপতীকে বলল, কি রে তপী, কোনদিকে যাবি?
তপতী বলল, যেদিকে খুশি
মৃন্ময় চট করে কী ভেবে নিল। আড়ে আড়ে একবার তাকিয়ে চোখ কুঁচকে ঠোঁট ছুঁচলো করে বলল, যদি খাদাঞ্চির দিকে যাই?
ঠোঁট কামড়ে আঁচলে আঙুল জড়াতে জড়াতে তপতী বলল, আহা, খাদাঞ্চি ছাড়া যেন পূর্ণিয়ায় আর কোনও জায়গা নেই–
নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কেন বাপু পেটে খিদে মুখে লাজ