তপতীর মা চোখ পাকালেন, তোর ল্যাজও এবার কাটাব। আজাদি চিড়িয়া হয়ে সারা জীবন উড়ে বেড়াবি, সেটি হবে না।
দোলনের পাশ থেকে ঝুলন দুম করে বলে বসল, মৃন্ময়দার ল্যাজ তত একবার কাটা গিয়েছিল।
পলকে সমস্ত ঘরটার হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য সবাই যেন বোবা।
ওদিকে হাজার হাতে এলোপাথাড়ি কালি ছুঁড়ে কেউ যেন মৃন্ময়ের মুখটা একেবারে বিকৃত কদর্য করে দিল। তার চোখের ওপর ধূসর সরের মতন কী পড়েছে। হাত-পা-ঠোঁট অসহ্য কঁপছিল। এক মিনিটও না। তারপরেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কাঁপিয়ে হেসে উঠল মৃন্ময়, ঠিক বলেছিস ঝুলন। ল্যাজ কাটার কথাটি আমার একদম মনে থাকে না। সবসময় হইচই করে কাটাই তো বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল মৃন্ময়, কিন্তু যেই একলা হই, টের পাই সেই কাটার ঘাটা—
তপতীর মা ধমকে উঠলেন, চুপ কর, যত সব আজে বাজে কথা
মৃন্ময় হাসতে লাগল; ঠিক আছে ফুলমাসি, এই মুখে চাবি দিলাম। তুমি তো আবার ওই ব্যাপারটা পছন্দ করো না। বলেই ঘাড় গুঁজে বড় বড় গ্রাস মুখে পুরতে লাগল মৃন্ময়।
খেতে খেতে থমকে গিয়েছিল সোমা। সে মৃন্ময়ের দিকে তাকাল, তাকিয়েই থাকল। মনিহারি ঘাটে আলাপ-টালাপ হবার পর এই প্রথম মৃন্ময়কে স্থির পলকহীন চোখে দেখল সোমা। একবার তার ইচ্ছা হল, তপতীকে জিগ্যেস করে মৃন্ময়ের ব্যাপারটা জেনে নেয়। পরক্ষণেই মনে পড়ল, সে একজন অধ্যাপিকা, গেঁয়ো মেয়েদের মতন কৌতূহল তার অন্তত শোভা পায় না।
হঠাৎ কি মনে পড়তে দ্রুত মুখ তুলল মৃন্ময়, ফুলমাসি, মেসোকে তো দেখছি না।
তপতীও প্রায় একই সুরে বলল, বাবা কোথায় মা?
তপতীর মা বললেন, আর কোথায়, সকালবেলা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে সাইকেলে করে যেখানে যান।
বা রে-আদুরে কিশোরীর মতন মুখ ভার করল তপতী, আমারা যে আসব বাবা জানে না?
তপতীর মা বললেন, জানে বইকি-
তবে বাড়িতে থাকল না যে?
নেশা। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়া চাই।
তুমি থাকতে বললে না কেন?
বলেছিলাম তো। তোর বাবা বললে তপীরা এসেই তো আর চলে যাচ্ছে না।
সন্ধেবেলা দেখা হবেখন।
সোমা কী ভাবল বলো তো?
সোমা ওপাশ থেকে বলে উঠল, রোজ সকালেই বেরিয়ে যান মেসোমশাই?
রোজ–তপতীর মা হাসলেন।
কোথায় যান?
বদ-বাদাড়ে–
কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতন তাকিয়ে থাকল সোমা, তপতীর বাবার সম্বন্ধে আর কোনও প্রশ্ন করল না।
কথায় কথায় খেয়াল ছিল না। হঠাৎ সোমার পাতের দিকে তাকিয়ে তপতীর মা বলে উঠলেন, এ কী মা-তুমি কিছুই তো খাওনি! সব পড়ে আছে।
না না, অনেক খেয়েছি।
তোমাকে আর দুখানা ঝালের মাছ দিই—
দুহাত দিয়ে পাত ঢেকে সোমা ভয়ের গলায় বলল, আমার পাতে প্রথমেই যা দিয়েছেন তা আমার তিনবেলার খাবার। তার ওপর আবার যদি দ্যান মরেই যাব মাসিমা।
তুমি লজ্জা করছ না তো মা?
টেবিলের শেষ মাথা থেকে ধাঁ করে মৃন্ময় বলে বসল, পেট ভরে না খেলে নিজেই কষ্ট পাবে; আমাদের কী–
সোমার চোখ ঈষৎ কুঁচকে গেল। মৃন্ময়ের দিকে না তাকিয়ে তপতীর মাকে বলল, লজ্জা করব কেন? আমি কতটা খাই তপতীকেই জিগ্যেস করুন না—
নাঃ, কিছুই খেতে পারো না দেখছি–তপতীর মা হাল ছেড়ে দিলেন।
মৃন্ময় আচমকা আবার মন্তব্য করল, একেবারে পক্ষীর আহার। খাবেন এইটুকু, রাত্তিরে ইনসমনিয়া–আছেন ভালো।
একটু আগে ওদের কথাবার্তা শুনে সোমার মনে হয়েছিল মৃন্ময়ের জীবনে কোথাও দুঃখ আছে। নিজের অজান্তেই খানিকটা সহনুভূতি বোধ করেছিল। এই মূহুর্তে তার মুখ আবার শক্ত হয়ে উঠল। লোকটার রুচিহীনতা অসহ্য।
২. খাওয়া-দাওয়ার পর
০৫.
খাওয়া-দাওয়ার পর সোমা আর তপতী তাদের নির্দিষ্ট ঘরটায় চলে এল। বোতাম টিপে মাথার ওপরকার ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে তপতী বলল, একটা কথা জিগ্যেস করব?
সোমা শুধাল, কী রে?
মৃন্ময়দার ওপর খুব চটে গেছিস, না?
সোমা উত্তর দিল না, তার মুখ কঠিন হয়ে উঠল।
বিছানায় এসে টান-টান শুয়ে পড়ল তপতী। বলল, রাগ করিস না ভাই; মৃন্ময়দাটা কোনরকম ফর্মালিটি জানে না, মুখে যা আসে দুমদাম বলে ফেলে। একেক সময় খুব খারাপ লাগে। কিন্তু মানুষটা ভারি সরল রে। দু-চারদিন মিশলে বুঝতে পারবি, কোনও রকম ঘোরপ্যাঁচ নেই।
সোমা আবছা জড়ানো গলায় কিছু বলল; বোঝা গেল না।
পাশ ফিরতে ফিরতে তপতী বলল, মৃন্ময়দাটা অদ্ভুত লোক। দারুণ দুঃখী, জীবনে ভীষণ ডিপ্রাইভড় হয়েছে, অথচ বাইরে থেকে বুঝবার উপায় নেই। সব সময় হই-হুঁল্লোড় করছে, তার গলা দ্রুত ঘুমে বুজে আসতে লাগল।
কোনও ব্যাপারেই সোমার বিশেষ আগ্রহ নেই। সে উদাসীন কৌতূহল শূন্য।
তবু নিজের অজান্তেই ফস করে বলে বলল, ডিপ্রাইভড হয়েছে মানে?
সে সপ্তকাণ্ড রামায়ণ, পরে শুনিস
কী ভেবে সোমা বলল, ঊনি তো দিল্লি থাকেন; তখন তাই বললি না?
হ্যাঁ, ঘুমন্ত গলায় উত্তর দিল তপতী।
একলাই থাকেন?
কী অস্পষ্টভাবে বলল তপতী, তারপরেই তার গলা ডুবে যেতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে তার নাক ডাকতে লাগল। ভারি বিশ্রী অভ্যাস তপতীর।
সোমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল কোথায় যেন সে দেখেছে স্রেফ নাক ডাকার জন্য একটা ডিভোর্স হয়ে গেছে। পরক্ষণেই সে জানালার বাইরে গোলাপ বাগানের দিকে তাকাল। ওখানে ঝক ঝক প্রজাপতি উড়ছিল, আর ফড়িং। ফাল্গুনের উল্টোপাল্টা এলোমেলো হওয়ার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখ জুড়ে আসতে লাগল সোমার। তপতীর পাশে শোয়ামাত্র সে ঘুমিয়ে পড়ল।