বৈদর্ভী সিগারেটটা এগিয়ে বলল, ইটস টু মাচ কিনি। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এবার থাম।
সিগারেটে টান দিয়ে মুখ লাল করে অনেকটা কাশল কিঙ্কিনি।
বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমার ওপর মায়ের খুব রাগ। বকাঝকা মারধর লেগেই থাকত। তুচ্ছ সব কারণে বেদম মার খেতাম। আজও মনে আছে একদিন দুপুরে খেতে বসে বলেছিলাম, লাউ করেছ চিংড়ি দাওনি কেন? লাউয়ের সঙ্গে চিংড়ি সবথেকে ভালো যায়। যদি কই মাছ হত তা হলে ফুলকপির কথা বলতাম। মা সেদিন ডালের হাতা দিয়ে আমাকে খুব মেরেছিল। দুপুরে খেতে পর্যন্ত দেয়নি। বলেছিল, খাওয়া নিয়ে বায়না করলে গোটা দিন উপোস করিয়ে রাখব। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি কী করেছি! বাবাই তো আমাদের এ সব বলত। বাজারের কম্বিনেশন শেখাত। গরম চায়ের কাপ হাতে খবরের কাগজ পড়েছিলাম বলে মা চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে ঠুকে দিয়েছিল। পরে মারধর বন্ধ হল কিন্তু মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো হয়নি। মায়ের রাগের কারণ প্রথমে বুঝতে পারতাম না। পরে পারলাম।
কী? অস্ফুটে বলল বৈদর্ভী।
আসলে একটা সময় পর্যন্ত আমি অনেকটাই বাবার মতো আচরণ করে ফেলতাম। বাবার মতো ভালো স্বভাব, বাবার মতো হাসিখুশি, বাবার মতো মজাদার। মা এটা নিতে পারত না। আমাকে মেরে বাবার ওপর রাগ ফলাত। আমি বোকা ছিলাম তাই ধরতে পারিনি, হি হি। আশ্চর্য না? যখন বুঝতে পারলাম, তখন ঠিক করলাম, খারাপ হয়ে যাব। বাজে মেয়ে। মদ খাব, গাঁজা খাব, রাত করে বাড়ি ফিরব, মেয়ে হয়ে মেয়ের সঙ্গে শোব। সেইসঙ্গে ওই মহিলাকেও মারব, আমার মাকে। মেরেই ফেলব। হি হি।
হাসতে লাগল কিঙ্কিনি। হাসতে হাসতে সোফার ওপর গড়িয়ে পড়ল। গড়াতে গড়াতে বলল, অ্যাই বৈদর্ভী এখান থেকে বেরিয়ে আমরা রেলগেটে যাব। ভাঙা মন্দিরের ঠেকে বসে ভদকা খাব। তুই শিবুকে খবর দে। শুনেছি জায়গাটা খারাপ। গিয়ে দেখব কত খারাপ হয়। শিবুকে এক্ষুনি খবর দে। হি হি।
বৈদর্ভী বলল, আচ্ছা সে দেব, আগে তুই হাসি থামা।
কিঙ্কিনি হেসে যেতেই থাকে। বলল, উফ পারছি না, পারছি না রে থামাতে…হি হি..।
বৈদর্ভীও হেসে উঠল বলল, বেটা গাঁজাখোর। দাঁড়া আমি তোর হাসি থামাচ্ছি।
গায়ের টি শার্টটা দ্রুত খুলে ফেলে দিয়ে বৈদর্ভী কিঙ্কিনির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পড়ে থমকে গেল। কিঙ্কিনি হাসছে কোথায়! তার দুটো চোখই যে ভেসে যাচ্ছে জলে! তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল বৈদর্ভী। চোখ খুলে জল মুছতে মুছতে কিঙ্কিনি বলল, মাকেও শেষ পর্যন্ত লিস্ট থেকে বাদ দিয়েছি। বেচারি মা আমার, কী হবে তাকে খুন করে? তার কী দোষ? কোনও দোষ নেই। যদি মারতেই হয়, আসল কালপ্রিটকে মারতে হবে। তার জন্যই তো সব। সে-ই যত নষ্টের গোড়া। আসল কালপ্রিটকে চিনিস বৈদর্ভী? হি ইজি মাই ফাদার। আমার বাবা শ্রীদেবনাথ চট্টোপাধ্যায়। একটা রিভলভার পেলে, ঢিসুম।
হাতে গুলি করার ভঙ্গি করল কিঙ্কিনি। তারপর পাশ ফিরে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
.
রাত আটটা নাগাদ পুলিশ হানা দেয় রেলগেটের ভাঙা মন্দিরে। রুটিন রেইড। মাঝেমধ্যেই পুলিশ এটা করে। নেশাখোরদের ধরে থানায় নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে ছোটখাটো ছিঁচকে চোর, ছিনতাইবাজ, গুন্ডা মস্তানরাও থাকে। কোনও কোনও দিন এক-দুজন মহিলাকেও পাওয়া যায়। পুলিশ এলে তারা ব্লাউজের ভেতর থেকে মুঠো করে কোঁচকানো দশ টাকার নোট বের করে। হাতে গুঁজে রেললাইন দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় দ্রুত। অনেক সময় পুলিশ যাদের ধরে কটা লাঠির ঘা দিয়ে ছেড়ে দেয়। কখনও আবার একরাত লকআপে রেখে পরদিন সকালে কোর্টে চালান করে। আজকের রুটিন রেইডে কজন যুবকের সঙ্গে দুটি অল্পবয়সি মেয়েও ধরা পড়েছে। একবার তাকিয়েই পুলিশ বুঝতে পারে, এরা জামার ভেতর থেকে টাকা বের করে দেওয়ার মেয়ে নয়। অন্য কোনও গোলমাল রয়েছে। জটিল কিছু। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অন্ধকার চাতালের একপাশে জড়ামড়ি করে পড়েছিল দুজনে। প্রায় জ্ঞান হারানো অবস্থা। তাদের টেনে হিঁচড়ে যখন ভ্যানে তোলা হচ্ছে, একটি মেয়ে জড়ানো গলায় বলল, দাদা, একটা রিভলভার হবে?
০৯. লোকটা জালিয়াত
০৯.
এক ঝলক দেখেই নীলাদ্রি বুঝতে পারল, লোকটা জালিয়াত। ছোটখাটো জালিয়াতি নয়, বড় ধরনের জালিয়াত। বড় ধরনের জালিয়াতরা আজকাল টিয়াপাখির বদলে কম্পিউটার, মোবাইল সাজিয়ে এমন কায়দায় বসে যেন বিজ্ঞান প্রযুক্তি ছাড়া এক পা-ও নড়ে না। মানুষের ভাগ্য, কুষ্ঠি বিচার, আংটির পাথর, মাদুলির সাইজ সব কী বোর্ড টিপে বলে দেয়। এই লোকও তাই করেছে। টেবিলের ওপর ল্যাপটপ সাজিয়ে বসেছে। প্রতি কথার পরেই খটখট আওয়াজ করে কী বোর্ড টিপছে। এখানে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। তবু সে চুপ করে আছে। কারণ এই লোকের কাছে তাকে নিয়ে এসেছে শ্রীময়ী। দুম করে উঠে গেলে শ্রীময়ীকে অপমান করা হবে।
লোকটা মুখ না তুলে বলল, কী হারিয়েছে ভাইটি?
নীলাদ্রি পাশে বসা শ্রীময়ীর মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, কী নয়, কে। আমার বাবা পাঁচ বছর হল নিখোঁজ।
লোকটা মুখ তুলে একবার নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকাল। বলল, ও। ফের ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তা বাবার নাম কী ভাইটি?
ভাইটি ভাইটি শুনতে অসহ্য লাগছে নীলাদ্রির। শুধু ভাইটি নয়, তুমি সম্বোধনেও তার আপত্তি। এই ধরনের বুজরুকদের এগুলো এক একটা অংশ।