এই সমস্যার সমাধান হল কদিনের মধ্যেই। এক রবিবার বিকেলে কলকাতা যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে যামিনী। বহুদিন পরে গালে হালকা পাউডার দিয়েছিল। কপালে টিপ। অর্ধেন্দুই। বলেছেন, একটু সেজেগুজে বেরোতে পার না? বাড়ির বিপদের কথা রাস্তার লোকদের জানিয়ে লাভ কী? বাড়ির গেট খুলে বেরোতেই মেয়ের মুখোমুখি পড়ল যামিনী। কিঙ্কিনি পড়ে ফিরছিল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। চোখে বিস্ময়। থতমত খেয়ে যায় যামিনী। নিজে থেকেই তাড়াতাড়ি বলে, তোর বাবার অফিসে যাচ্ছি।
আজ! আজ তো রবিবার। বিড়বিড় করে কিঙ্কিনি।
চমকে ওঠে যামিনী। নিজের ভুল বুঝতে পারে। সত্যি তো আজ রবিবার, অফিস বন্ধ। দ্রুত নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে। ভুল করে বসে ফের। বলে, ইউনিয়ন অফিস খোলা থাকবে। তারপর মাথা নামিয়ে হন হন করে হেঁটে যায়। পিছনে তাকায় না তবু বুঝতে পারে কিঙ্কিনি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি কিঙ্কিনির নয়, সেই দৃষ্টি তার স্বামীর, দেবনাথের। বুকটা টনটন করে ওঠে যামিনীর। দেবনাথ হারিয়ে গিয়েও পুরোটা হারায়নি, তার মেয়ের মধ্যে থেকে গেছে অনেকটা।
মোবাইল ফোন বন্ধ করে স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরে আসে যামিনী। রাতে অর্ধেন্দু ল্যান্ড ফোনে ধরলে যামিনী শান্ত গলায় ফিসফিস করে বলে, দোহাই আপনাকে, আপনি আর কখনও আমাকে ফোন করবেন না। ওপাশের অপমানিত, ক্রুদ্ধ মানুষটা কিছু বলতে চান। যামিনী সুযোগ দেয়নি। ফোন নামিয়ে রেখেছিল।
সেই শেষ। আবার এতদিন পরে এবাড়িতে ফোন করেছিলেন অর্ধেন্দু দত্ত। সাড়ে তিনবছর পর। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নীলাদ্রি অফিসে এসেছে। ইউনিয়নরুমে লোকের আনাগোনা লেগেই আছে। প্রায় সকলেই নীলাদ্রির দিকে তাকাচ্ছে। মনে হয় না চিনতে পারছে। পারার কথাও নয়। নীলাদ্রির অস্বস্তি বাড়ছে। অর্ধেন্দুকাকু পরিচয় দিয়ে না বসে। সেরকম কিছু হল না। ঘর ফাঁকা হওয়ার পর উনি একটু হেসে বললেন, আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না নীলাদ্রি। তোমার মা বারণ করবেন।
নীলাদ্রি বলল, না না। বারণ করবে কেন!
অর্ধেন্দু দত্ত আবার একটু হাসলেন, তোমার বাবার টাকা পয়সার তো কিছুই করতে পারলাম না, রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক।
ছি ছি এটা কী বলছেন! আপনি অনেক করেছেন, নিয়ম না থাকলে কী হবে?
যাই হোক, শোনো নীলাদ্রি, এই অফিসে লোক নেওয়া হবে। পার্মানেন্ট জব। মাইনেকড়ি খারাপ নয়। বড় কথা হল সব সুযোগ-সুবিধেও রয়েছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি। আমাদের ইউনিয়নের কোটা আছে। দু-তিনজনের জন্য আমরা বার্গেন করি। শেষপর্যন্ত একজনে এসে ঠেকে। আমি তোমার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু সমস্যা হল, তোমার যা কোয়ালিফিকেশন দেখছি। তাতে ওপরের দিকে কিছু করা যাবে না। তুমি তো জানো আজকাল প্লেইন গ্র্যাজুয়েট কোনও ব্যাপার নয়। এম এ পাসও পিওনের পোস্টে অ্যাপ্লাই করে। তুমি কি রাজি?
নীলাদ্রি বলল, কাজটা কী?
অর্ধেন্দু দত্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, তুমি যদি রাজি হও আমি ব্যবস্থা করে ডিরেক্ট আমার আন্ডারে নিয়ে আসব। আমার কাছে কাজ করলে তো আর তোমার অতটা খারাপ লাগবে না। তোমার বাবা নেই, টাকাটা তোমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
নীলাদ্রি অবাক হল। কাজ করতে খারাপ লাগবে! সে আবার বলল, কাজটা কী?
অর্ধেন্দু দত্ত হাতের পেনটা টেবিলে ঠুকে বললেন, খাতায় কলমে পিওন-টিওন যা-ই লেখা থাকুক, আমার কাছে থাকলে এই অ্যাসিসটেন্ট গোছেরই কাজ মনে করবে। চাকরিটা কিন্তু পাকা নীলাদ্রি, ভালো করে ভাব। পিওন হলে হতচ্ছেদ্দা করার কিছু নেই। বিদেশে তো সব কাজই সমান। বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। বলবে, আমি বলেছি।
নীলাদ্রি কাঁদে না। আজও কাঁদল না। বিকেলে বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে নিজের মনের ফিসফিস করে বলল, বাবা, তুমি আমাদের এতবড় অপমানের মধ্যে ফেলে গেলে কেন? আমরা কী দোষ করেছিলাম?
০৫. কিঙ্কিনি সত্যি কথাই বলেছিল
০৫.
কিঙ্কিনি সত্যি কথাই বলেছিল। সে পিকনিক করতে যেখানে এসেছে সেটা জায়গা হিসেবে খানিকটা ভয়ঙ্করই। স্টেশন থেকে ভ্যানরিকশাতে চেপে চল্লিশ মিনিটেরও বেশি সময় লাগল। পাকা রাস্তার কোনও বালাই নেই। গোটাটাই গ্রামের এবড়ো-খেবড়ো মাটির পথ। খানিকটা আবার খেতের মধ্যে দিয়ে যেতে হল। ভ্যান লাফাতে লাফাতে চলেছে। যত এগিয়েছে পথ এই সকালেও জনমানব শূন্য হয়েছে। নির্জন পথের পাশে একটা ঝাপসা জারুলগাছ দেখে শালিনী হইহই করে উঠল–
অ্যাই থামো থামো। এই তো গাছ।
ভ্যান রিকশাতে ব্রেক নেই। বুড়ো চালক লাফ দিয়ে নেমে হ্যাঁন্ডেল টেনে ধরল। পিছনে পা ঝুলিয়ে বসা তিন মেয়ে ঝপাঝপ লাফ দিয়ে নামল। ভ্যানের মাঝখানে বাবু হয়ে বসেছিল বৈদর্ভী। সে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। মাটির ওপর উবু হয়ে পা চেপে ঝাঁকিয়ে উঠল, ওরে বাবা, মরে গেলাম।
বাকি তিনজন সেই কাতরানি পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে গেল। দোয়েল অবাক গলায় বলল, গাছ দিয়ে কী হবে রে শালিনী! আমরা কি গাছে বসে পিকনিক করব?
কিঙ্কিনি কোমরে হাত দিয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে বলল, সমস্যা কী? পিছনে একটা করে ল্যাজ লাগিয়ে উঠে যাব। তোর অবশ্য লাগাতে হবে না। ওরিজিনালটা বের করবি।