হ্যাঁরে, সিগ্রেট আছে?
হ্যাঁ, আছে।
কী সিগ্রেট আছে?
বাবু, পাশিংশো আর সিজার।
এক প্যাকেট সিজার দে।
অভয়চরণ বেশ লজ্জিত হয়ে বলে, বাবু পুরো প্যাকেট তো হবে না।
যা আছে তাই দে।
ভদ্রলোক পাশ ফিরে ওর সহযাত্রী বন্ধুকে বলেন, শালা গোবিন্দবাবুকে সিগ্রেট না খাওয়ালে তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখবে।
ও শালা, মহা খচ্চর আছে। বিল থেকে তো বিশ-পঁচিশ টাকা কেটে রাখার পরও ছোটলোকটাকে সিগ্রেট খাওয়াতে হবে।
অন্য বাবু বলেন, তোর কত হয়েছে?
চার আনার চা, চার আনার বিস্কুট আর তিন আনার…
এক টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরে উনি বলেন, এই নে ধর।
অভয়চরণ পাঁচ আনা ফেরত দেবার জন্য এগিয়ে ধরতেই বাবু বলেন, একটা ম্যাচ বক্স দে।
হ্যাঁ, অভয়চরণ দেশলাই আর বাকি পয়সা ভদ্রলোকের সামনে ধরতেই উনি দেশলাইটা তুলে নিয়ে বলেন, ওটা রেখে দে।
ওরা তখনও মোটর সাইকেলে স্টার্ট দেন নি, হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়িতে বসে বসেই এক ভদ্রলোক অভয়চরণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, চা হবে?
হ্যাঁ, বাবু, হবে।
কেক আছে?
আজ্ঞে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেকারীর কেক আছে।
চারটে চা–চারটে কেক দাও।
বাবু, এক আনার চা দেব নাকি দু’আনার–
না, না, এক আনার চা দিও না।
অভয়চরণ চা বানাতে বানাতেই দেখে, বাবুরা গাড়িতে বসে বসেই খুব গম্ভীর হয়ে কথা বলছেন; ওদের চোখ মুখ দেখে ওর মনে হয়, বাবুরা খুব জরুরী কাজে যাচ্ছেন।
অভয়চরণ ওদের চা আর কেক দিয়ে একটু দূরে দাঁড়ায় গেলাসগুলো ফেরত নেবে বলে।
একটু পরেই আগের বাবুই গাড়ির ভিতর থেকে একটু মুখ বের করে বাঁ হাতে তুড়ি মেরে অভয়চরণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আরো চারটে কেক দাও।
এক মিনিটের মধ্যেই অভয়চরণ ওদের কেক দেয়।
ওদের চা খাওয়া শেষ হতেই ওরা গেলাস ফেরত দেন।
কত হয়েছে?
বাবু, আটটা কেক একটাকা আর চারটে চা আট আনা।
ভদ্রলোক দু’টাকার একটা নোট ওর হাতে দিতেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করে; অভয়চরণ গলা চড়িয়ে বলেন, বাবু, পয়সা…
গাড়ি ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক এইভাবে খদ্দেরের পর খদ্দের আসায় অভয়চরণ নিজে একটু চা আর বিস্কুট খাবার ফুরসত পায়নি। এতক্ষণ খালি পেটে থাকায় পেটের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করে। না, আর দেরি না করে এক গেলাস চা তৈরি করার পর একটা বিস্কুট নিতে গিয়েও নেয় না, ও আপনমনেই একটু হেসে একটা কেক তুলে নেয়।
খুব খুশি মনেই অভয়চরণ চা-কেক খেতে শুরু করে আর মনে মনে চিন্তা করে এইভাবে যদি খদ্দের আসে তাহলে তো দোকানের স্টক বাড়াতে হবে কিন্তু স্টক বাড়িয়ে রাখবে কোথায়? দোকান বড় করতে হলে তো অনেক টাকা চাই কিন্তু ও কোথায় টাকা পাবে? এইসব সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতেই অভয়চরণ ঠিক করে, দোকান ঘর বড় করতে না পারলেও কিছু স্টক বাড়াতেই হবে।
পাঁচ-সাত মিনিট পরই হরেন সাপ্লায়ারের মোপেড এসে থামে। মোপেডের ইঞ্জিন বন্ধ করেই উনি অভয়চরণের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই এরই মধ্যে দোকান খুলেছিস?
অভয়চরণ এক গাল হেসে বলে, কাকা, আজ ছ’টার আগেই দোকান খুলেছি।
কী বলছিস তুই?
কাল রাত্রে আমি দোকানেই ঘুমিয়েছি।
এইটুকু দোকানের মধ্যে ঘুমোলি কী করে?
গুটিসুটি মেরে শুয়েছিলাম।
অভয়চরণ গম্ভীর হয়ে বলে, কাকা দশটা-এগারোটায় দোকান খুলে আর সন্ধে লাগতে না লাগতেই দোকান বন্ধ করে বিশেষ কিছুই হচ্ছিল না। তাইতো ঠিক করেছি, এই দোকানেই থাকব আর সপ্তাহে একদিন দুপুরের দিকে বাড়ি গিয়ে মাকে সংসার খরচের টাকা পৌঁছে দেব।
তুই ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। তুই যদি ভোর থেকে রাত আটটা ন’টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে পারিস, তাহলে তোর আয় প্রচুর বেড়ে যাবে কিন্তু তোর খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?
কাল তো মুড়ি আর বাতাসা খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। তবে ঠিক করেছি মা-র কাছ থেকে দু’একটা বাসন এনে রোজ একটু সিদ্ধ ভাত খাবো।
যেভাবেই হোক ভাত খাবি, তা না হলে শরীর ভেঙে যাবে।
অভয়চরণ ওর হাতে চায়ের গেলাস তুলে দেয়।
হরেন এক চুমুক চা খেয়েই বলেন, আজ সকালে কেমন খদ্দের হল?
অভয়চরণ এক গাল হেসে বলে, খুব ভাল, প্রায় সব স্টকই শেষ।
তাহলে তো ভালই বলতে হবে।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, বল কী কী দেব।
কাকা, সবই বেশি বেশি করে চাই। তাছাড়া দু’এক রকম একটু ভাল বিস্কুটও রাখব।
যত বেশি রকমের জিনিষ রাখবি তত বেশি বিক্রি হবে। আমি থাকতে তোকে মালপত্তরের চিন্তা করতে হবে না।
কিন্তু কাকা, ইচ্ছা থাকলেও তো বেশি জিনিষ এইটুকু দোকানে রাখতে পারব না।
যদি ভাল বিক্রি হয়, তাহলে দোকানটা বড় করতে হবে।
সে তো অনেক টাকার ব্যাপার।
হরেন একটু হেসে বলেন, ব্যবসা বাড়াবার জন্য টাকার অভাব হয় না।
হরেন সাপ্লায়ার আর কথা না বাড়িয়ে ওকে সবরকমের মালপত্র অনেক বেশি দিয়ে মোপেডে স্টার্ট দেন।
যাইহোক অভয়চরণ স্বপ্নেও ভাবেনি, সারাদিন দোকান খোলা রাখলে এত বিক্রি হতে পারে। পরের দিন ও হরেন সাপ্লায়ারকে বলে, জানেন কাকা, কাল ভোর ছ’টা থেকে রাত নটা পর্যন্ত দোকান খোলা রেখে যা বিক্রি হয়েছে, তা আগে এক সপ্তাহেও হত না।
হরেন সাপ্লায়ার একটু হেসে বলেন, ওরে অভয়, ভুলে যাস না এইটাই ভূটান আর আসাম ছাড়া ওই দিকের সর্বত্র যাবার মেন রাস্তা। তাছাড়া এই রাস্তা দিয়েই চা বাগানগুলোয় যেতে হয়। এই রাস্তার উপর যাদেরই দোকানে ভাল স্টক থাকবে তাদেরই বিক্রি ভাল হতে বাধ্য।