বিমলবাবু আর অনুপমা দেবী হাসতে হাসতে বলেন, দুটোই তো-দারুণ ভাল শাড়ি।
দুটোই দারুণ ভাল শাড়ি, দুটোই দারুণ দামী শাড়ি কিন্তু শান্তবাবুকে বারবার বারণ করা সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনিলেন না।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমি যা ইচ্ছে তাই তোকে দেব; তাই তোকে নিতে হবে। ব্যবহারও করতে হবে।
এবার মৌ আরেকটা প্যাকেট খুলে দুটো ধুতি বের করে বলে, বাবা, তোমার ধুতি।
ধুতি দুটো হাতে নিয়ে বিমলবাবু খুশির হাসি হেসে বলেন, বাঃ! খুব সুন্দর।
মৌ এবার অন্য প্যাকেট থেকে একটা শাড়ি বের করে বলে, ভাল ছেলে তার ভাল মা-কে এই দুটো শাড়ি দিয়েছে।
শাড়ির উপর হাত রেখেই অনুপমা দেবী একটু হেসে বলেন, বুঝলি মৌ, এবার এই শাড়ি পরে বুক ফুলিয়ে সবাইকে বলতে পারব, আমার ভাল ছেলে এই সব শাড়ি দিয়েছে।
শান্ত অনুপমা দেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে, মাতৃদেবী, বড্ড খিদে লেগেছে; প্লিজ এবার খেতে দাও।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চল।
খাওয়া শুরু করেই বিমলবাবু বলেন, শান্ত, রিয়েলী ভেরি গুড ফুড; তোের পছন্দ আছে।
অনুপমা দেবী স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ভুলে যেও না, তাজ বেঙ্গলের খাবার। ওখানকার খাবার কখনো খারাপ হতে পারে?
খাওয়া-দাওয়ার পর হোটেলে ফিরে যাবার আগে শান্ত বলে, ওহে মৌ দেবী, কাল কী আমার সঙ্গে একটু ঘুরাঘুরি করতে পারবেন? আপনি থাকলে আমার একটু উপকারই হবে।
আপনার উপকার করিতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত।
ভাল কাকা-ভাল মাকে প্রণাম করে শান্ত গাড়িতে ওঠে।
৫-৬. বিমলবাবুদের আদি নিবাস
বিমলবাবুদের আদি নিবাস জলপাইগুড়ি। ওর ঠাকুর্দা অভয়চরণ অর্থাভাবে স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতেই পড়াশুনা ছাড়তে বাধ্য হন ও তরাই অঞ্চলে বাবার সামান্য চা-বিস্কুটের দোকানে কাজ করতে শুরু করেন। অভয়চরণ যখন মাত্র ষোল বছরের তখন ওর পিতৃবিয়োগ হয় ও বিধবা মা আর দুটি ছোট বোনের দায়িত্ব তাকে নিতে হয়। উনি পরিশ্রম করতে কখনই কুণ্ঠাবোধ করতেন না; তাইতো উনি ঠিক করলেন, ভোর থেকে একটু রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখবেন।
ওদের বাড়ি থেকে বড় রাস্তার ধারের ওই দোকান ছিল প্রায় বারো মাইল দূরে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করলে কোনমতেই সাড়ে ন’টা-দশটার আগে দোকান খোলা সম্ভব হত না; দোকান বন্ধ করতে হত সন্ধে হতে না হতেই। অভয়চরণ জানতেন, ওদের চায়ের দোকানের সামনের রাস্তা দিয়েই শুধু কোচবিহার বা তরাইয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে না, ভূটানেও যাতায়াত করতে হয় লোকজন ও গাড়িকে। ওই অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানে যারা কাজকর্ম বা ব্যবসা করেন, তারাও ভোরবেলায় ওই রাস্তা দিয়ে যান ও বিকেল-সন্ধের দিকে ফেরেন। অভয়চরণ ঠিক করলেন ভোর হতে না হতেই ওকে দোকান খুলতে হবে ও খোলা রাখতে হবে সন্ধে ঘুরে যাবার পরও দু’তিন ঘণ্টা।
মা, কাল থেকে আমি দোকানেই থাকব।
দোকানে থাকবি কেন?
ভোরে দোকান খুললে অনেক খদ্দের পাব; দোকান বন্ধও করব একটু রাত করে।
ঘুমুবি কোথায়?
দোকানেই ঘুমোব।
খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?
দোকানের কাছেই একটা বাড়ি আছে, ওই বাড়ির ছেলের সঙ্গে আমার খুব ভাব। ওর মা-ও আমাকে খুব ভালবাসেন। ওরাই আমাকে খেতে দেবেন।
কিন্তু…
অভয়চরণ ওর মা-র দুটি হাত ধরে বলে, তুমি কিছু চিন্তা করো না, সত্যি আমি ভাল থাকব।
অভয়চরণের মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কী আর বলব! আমাদের পেট চালাবার জন্য তোকে কি কষ্টই করতে হবে।
মা, তুমি বিশ্বাস করো আমার কোন কষ্ট হবে না।
.
অভয়চরণ নিরুপায়। তাইতো ওকে মিথ্যে কথা বলেই দোকানে থাকার অনুমতি নিতে হয়।
অভয়চরণ শুরু করে নতুন সংগ্রাম।
সূর্য ওঠার অনেক আগেই অভয়চরণ ঘুম থেকে উঠেই আবছা অন্ধকারে গাছপালার আড়ালে যায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। তারপর মুখ ধুয়েই উনুন ধরিয়ে চায়ের জল বসিয়ে দুধের পাত্র উনুনের পাশে রাখে।
কী আশ্চর্য! জল ফুটতে না ফুটতেই তিনজন খদ্দের এসে হাজির।
চা হবে?
হ্যাঁ, বাবু, হবে।
আমাদের তিনটে স্পেশাল চা দাও।
হ্যাঁ, বাবু, দিচ্ছি।
অভয়চরণ ওদের হাতে চায়ের গেলাস তুলে দিতেই একজন বলেন বিস্কুট দাও।
বাবু, তিনজনকেই দেব?
হ্যাঁ, তিনজনকেই দেবে।
বাঁশ দিয়ে তৈরি বেঞ্চিতে বসে বাবুরা চা-বিস্কুট খায়।
বাঃ! বেশ চা বানাতে পারিস তো তুই।
অভয়চরণ একগাল হেসে বলেন, আপনাদের ভাল লেগেছে?
হ্যাঁ, সত্যি ভাল লেগেছে। আমাদের আরো তিনটে চা দাও।
হ্যাঁ, বাবু, দিচ্ছি।
দ্বিতীয়বার ওদের চা খাওয়া শেষ হতেই একজন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করেই বলেন, তোর কত হয়েছে?
বাবু, ছ’টা চা বারো আনা আর তিনটে বিস্কুট তিন আনা মোট পনের আনা।
ভদ্রলোক এক টাকার একটা নোট অভয়চরণকে দিয়ে বলেন, তোকে আর এক আনা ফেরত দিতে হবে না।
অভয়চরণ ডান হাত কপালে ছোঁয়ায়।
খুশিতে ভরে যায় ওর মন।
দু’এক মিনিট পরই একটা মোটর সাইকেল এসে থামে ওর দোকানের সামনে। মোটর সাইকেলে বসে বসেই একজন বলেন, চা হবে?
হ্যাঁ, বাবু, হবে।
চা কত করে?
এক আনা করে।
না, না, এক আনা না, দু’আনা করে চা দে আমাদের দু’জনকে।
এখনই দিচ্ছি।
অভয়চরণ ওদের হাতে বড় গেলাসের চা দিতেই একজন বাবু বলেন, দুটো করে বিস্কুট দে।
চা বিস্কুট খাওয়া শেষ হতেই এক বাবু অভয়চরণের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই তো বেড়ে চা করিস।
অভয়চরণ কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে।