তো?
কোন রবিবার বাজার যাই না বলতে পারো?
অনুপমা সে কথার উত্তর না দিয়েই চলে যান।
রবিবার সকালে বাজার যাবার ঝামেলা নেই অপূর্ববাবুর। উনি শনিবার অফিস থেকে ফেরার পথে জগুবাবুর বাজার বা লেক মার্কেট থেকে সারা সপ্তাহের বাজার করে বাড়ি ফেরেন।
যাইহোক বিমলবাবু বাজার থেকে ফেরার পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই অপূর্ববাবু এসে হাজির হবেনই।
কী হে বিমল। বাজার থেকে কখন ফিরলে?
এই তো একটু আগে।
এ রবিবার ঘুম থেকে উঠেই বাজার যাওয়া সত্যি ঝামেলার ব্যাপার তাই না?
হ্যাঁ, দাদা, ঠিকই বলেছ কিন্তু না গিয়ে তো উপায় নেই; অন্য কোনদিন তো বাজারে যাবার সুযোগ নেই।
উইক ডে’জ-এ তত তোমাকে বড্ড সকাল সকাল বেরুতে হয়।
হ্যাঁ, দাদা।
বিমলবাবু না থেমেই বলেন, সপ্তাহে পাঁচদিনই তো আমাকে মেয়েদের মর্নিং সেকশনে দুটো ক্লাস নিতে হয় সওয়া আটটায় আর ন’টায়। বহু অনুরোধ উপরোধ করেও এই ক্লাস দুটো ছাড়তে পারছি না।
কলেজ থেকে ফিরতেও তো তোমার বেশ দেরি হয়।
সপ্তাহে একদিন শুধু আড়াইটেতে ক্লাস শেষ হয়; শুধু সেদিনই বাড়ি ফিরে খেতে পারি।
ঠিক সেই সময় অনুপমা দু’কাপ কফি নিয়ে ঘরে ঢোকে। এক কাপ অপূর্ববাবুর দিকে এগিয়ে ধরে বলেন, দাদা, এই নিন।
অন্য একটা স্বামীর সামনে ধরে বলেন, তুমি ধরো।
কফির কাপে একবার চুমুক দিয়েই অপূর্ববাবু বলেন, সিস্টার, কী রান্না করছ?
অনুপমা একগাল হেসে বলেন, মনিকা তো সকালেই বলেছে এই সপ্তাহে তিন দিন ইলিশ খাওয়াবে, তাই শুধু তেতোর ডাল করছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, দাদা।
আমাকে এক বাটি পাঠিও তো।
অনুপমা আবার হাসতে হাসতে বলেন, আপনি না বললেও ঠিকই পাঠাতাম।
জানো সিস্টার, তোমার হাতের নিরামিষ রান্না-খেলেই মায়ের রান্নার কথা মনে হয়। তোমার নিরামিষ রান্না এক কথায় পূর্ব।
আপনি আমাকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করেন বলেই আমার রান্না আপনার এত ভাল লাগে।
হ্যাঁ, তা বলতে পারো।
অপূর্ববাবু একটু হেসে বলেন, সিস্টার, আসল কথা হচ্ছে, প্রিয়জন ভালবেসে যা দেয়, তা পাবার আনন্দই আলাদা।
হ্যাঁ, দাদা, ঠিক বলেছেন।
আসল কথা হচ্ছে, এই যে আমি তোমাকে ছোটবোনের মতো স্নেহ করি, ভালবাসি, তুমি যে আমাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করো, ভালবাসো, বা ঘটনাচক্রে আমরা দুটো পরিবার এত ঘনিষ্ঠ হয়েছি, আজকাল এই ধরনের সম্পর্ক দুর্লভ হয়েছে। এ যুগের মানুষ বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়েছে।
একদম ঠিক কথা বলেছেন। বিমলবাবু বলেন, দাদা, তুমি খুব ভাল করেই জানো, আগে কলকাতায় পাড়াকেন্দ্রিক একটা সম্পর্ক ছিল। আগে পাড়ার মধ্যেই আমাদের ঠাকুমা, বড় জ্যেঠিমা, ছোট জ্যেঠিমা, ভাল কাকা, নতুন কাকা, বড়দি, মেজদি, রাঙাদি ইত্যাদিকে নিয়ে আমরা কি আনন্দেই থেকেছি; আজকাল তা কল্পনাও করা যায় না।
অপূর্ববাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ ভাই, ঠিক বলেছ। আগে আমাদের বাগবাজার পাড়ায় রোজ সন্ধেবেলায় একদল বয়স্ক মানুষ তাস আর পাশা খেলায় মেতে উঠতেন। আমার বাবা প্রতিদিন সন্ধের পর তাসের আড্ডায় না গেলে শান্তি পেতেন না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, আমার মা আবার নাটক দেখতে খুব ভালবাসতেন; তিনি চিরকাল নাটক দেখতে গিয়েছেন পাড়ার রাঙা ঠাকুরপো আর তার স্ত্রী বা বৌদির সঙ্গে।
বিমলবাবু বলেন, দাদা, তুমি বোধহয় স্বীকার করবে পাড়াভিত্তিক এই কালচার, এই সম্পর্ক নষ্ট হল প্রথমে পার্টিশন আর অপর নকশাল আন্দোলনের জন্য। এই নকশাল আন্দোলনই আমাদের মধ্যে এমন সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বীজ পুঁতে দিল যে পাড়ার অতি পরিচিতজনও আমাদের অপরিচিত মনে হতে শুরু হল।
হ্যাঁ ভাই, তুমি ঠিকই বলেছ।
অনুপমা বলেন, দাদা, এই পাড়াতে আমরা অনেকেরই মুখ চিনি কিন্তু আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি।
জানো সিস্টার, আমি তোমার দিদিকে কী বলি?
কী বলেন?
বলি, পুরীতে তোমাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ঘনিষ্ঠতা না হলে তোমার ঊরুর হাড় ভাঙার পর তিন-চার মাস তোমার ছেলেকে কে দেখত?
অনুপমা একটু হেসে বলেন, দাদা, ভুলে যাবেন না জগন্নাথদেবই আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন।
হ্যাঁ সিস্টার, ঠিকই বলেছ।
অপূর্ববাবু সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়ে দুটোর কপাল দেখো। মৌ ছাড়া আমাদের ছেলের কোন বন্ধু নেই। আবার আমাদের ছেলে ছাড়া মৌ-য়ের কোন বন্ধু নেই অথচ এই পাড়ায় কী কম ছেলেমেয়ে আছে?
হ্যাঁ দাদা, সত্যিই তাই।
হঠাৎ মনিকা দেবী এসে হাজির। উনি ঘরে ঢুকেই স্বামীকে বলেন, বাড়িতে ফিরে যে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে তা কী ভুলে গিয়েছ?
কী আশ্চর্য! এত বকবক না করে মাছের ঝোলের পাত্রটা হাতে করে আনলেই তো এখানেই তেতোর ডাল আর মাছের ঝোল দিয়ে দু’মুঠো ভাত খেতে পারতাম।
অনুপমা সঙ্গে সঙ্গে নেচে ওঠেন। উনি মনিকা দেবীকে বলেন, তুই প্লিজ মালতাঁকে বলে দে…
তুই তো আচ্ছা পাগলামী শুরু করলি!
অপূর্ববাবু হাসতে হালতে বলেন, তোমাদের কাউকে কিছু করতে হবে না। আমি আর মালতী সব নিয়ে আসছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ নিয়ে এসো।
.
এইভাবেই মিলেমিশে দুটি পরিবারের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তো দূরের কথা, চলে যায় বছরের পর বছর।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর মনিকা আর অনুপমা গল্পগুজব করছেন।
জানিস মনিকা, এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, এই তো সেদিন পুরী বেড়াতে গিয়ে তোদের সঙ্গে আলাপ। বাবা জগন্নাথদেবের কৃপায় তোর মতো বন্ধু আর দাদার মতো বড় ভাই পেলাম। আমরা নিজেরা তিন বোন, কোন ভাই নেই। তাইতো দাদাকে পেয়ে আমার যে কি আনন্দ। কি তৃপ্তি পেয়েছি, তা বলতে পারব না।