এইভাবেই শুরু হল দুটি পরিবারের ঘনিষ্ঠতা।
.
মনিকাদি, তুমি এই শাক আর টক ডাল দিয়ে ভাত খেও; তোমার ভাল লাগবে।
মনিকা একগাল হেসে বলেন, তুমি কী আজকাল আমার অবস্থা চিন্তা করেই রান্না করছ?
শুধু তোমার জন্য তো রান্না করিনি; আমরাও তো খাবো।
এ সে যাইহোক আমাকে কী রোজই তোমার কিছু না কিছু দিতে হবে?
কী আশ্চর্য! আমি কী রোজ রান্না করি না?
অনুপমা না থেমেই বলেন, তুমি অত-শত প্রশ্ন করবে না। আমি যখন যা দেব, তোমাকে তা খেতে হবে।
মনিকা হাসতে হাসতে বলেন, তুমি ভালবেসে দিচ্ছ আর আমি খাব না, তাই কখনো হয়?
দেখতে দেখতে দুটো মাস কেটে গেল।
তারপর একদিন মনিকার ছেলে হয়।
এই ছেলেকে দেখতে ওদের কত আত্মীয়স্বজন আসেন, চলেও যান।
অনুপমা সংসারের কাজকর্ম রান্নাবান্না নিয়ে সকালে বেশ ব্যস্ত থাকে কিন্তু স্বামী অফিস রওনা হলেই চলে যায় ও বাড়ি।
ছেলেটাকে আমার কাছে দে তো; ওকে একটু প্রাণভরে আদর করি।
তুই বোধহয় জলখাবার না খেয়েই এসেছিস?
এত সকাল সকাল আবার কবে খাই?
বাজে বকিস না; সওয়া ন’টা বাজে। কেউ জলখাবার কী দশটা-এগারোটায় খায়?
সে কথা অনুপমার কানেও যায় না। উনি ছেলেকে আদর করতেই ব্যস্ত।
মনিকা গলা চড়িয়ে বলেন, মালতী আমাকে আর অনুকে খেতে দিবি?
মালতী রান্নাঘর থেকেই জবাব দেয়, হ্যাঁ, মা, দিচ্ছি।
একটু পরেই ও ওদের দুজনকে জলখাবার খেতে দেয়।
নে অনু, শুরু কর।
আচ্ছা মনিকা, আমাকে কী রোজই তোর সঙ্গে খেতে হবে?
আমার সঙ্গে খেলে কী তোর জাত যাবে?
অনুপমা হাসতে হাসতে খেতে শুরু করেন।
খাওয়া শেষ হতেই অনুপমা বলেন, মনিকা ছেলের তেলটা দে তো; আমি বাবুসোনাকে ভাল করে তেল মাখিয়ে দিই।
মনিকা তেলের শিশিটা এগিয়ে দিয়ে একটু হেসে বলেন, নে, প্রাণভরে তেল মাখা।
তুই কী জানিস না, বাচ্চাদের ভালভাবে মালিশ করে তেল না মাখালে ওদের শরীর ভাল হয় না?
জানব না কেন? তাই বলে তোর মতো ঘণ্টাখানেক ধরে কেউ তার বাচ্চাকে তেল মাখায় না।
.
তারপর?
চাকা ঘুরে যায়। বছর তিনেক পর অনুপমা গর্ভবতী হলেন।
ভূমিকায় অদল-বদল হল। এবার অনুপমার ভূমিকায় মনিকা, মনিকার ভূমিকায় অনুপমা।
শোন অনু, এই সুক্তো খাবি, আর এই আচার রেখে গেলাম। মাঝেমধ্যে একটু আচার খেলে ডাল-তরকারী খেতে ভালই লাগবে।
তুই আগে যে আচার দিয়েছিলি, সেটাও খুব ভাল ছিল।
মনে হয়, এটাও তোর ভাল লাগবে।
ছেলেটাকে নিয়ে এলি না কেন?
ও এখন এত ছটফটে আর দুরন্ত হয়েছে যে ও হয়তো তোর পেটে লাথি-টাথি লাগিয়ে দেবে।
বাবুসোনা কখনই লাথি-টাথি লাগাবে না; তুই এখনি মালতাঁকে দিয়ে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দে।
সত্যি পাঠাব?
একশ’বার পাঠাবি।
অনুপমা একটু হেসে বলেন, ও এলে আমার সময়টা বেশ ভাল কাটবে।
তারপর একদিন অনুপমা কন্যা সন্তানের মা হলেন।
.
এই মেয়ে যখন বছর খানেকের, তখন ওরা আবার একসঙ্গে পুরী গেলেন এক সপ্তাহের জন্য। মহানন্দে এক সপ্তাহ কাটিয়ে হাওড়া স্টেশনে ফিরেই অঘটন। মনিকা দেবী হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই স্লিপ করে পড়ে গিয়েই বেদনায় বিকট চিৎকার করেন।
তারপর সোজা উডল্যান্ডস নার্সিংহোম। অর্থপেডিক একবারূরীক্ষা করতেই তার মুখ গম্ভীর হল।
মিঃ সরকার, আমার মনে হচ্ছে ঊরুর হাড় দু’জায়গায় ফ্র্যাকচার হয়েছে। এক্স-রে রিপোর্ট দেখে অপারেশন করে স্টীলেরড ঢোকাতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।
অর্থপেডিকের সন্দেহই ঠিক ছিল।
ডাঃ ঘোষ বললেন, কাল সকালেই অপরেশন করব।
পরের দিন সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে অপারেশন করার পর ও. টি থেকে বেরিয়ে ডাঃ ঘোষ বললেন, অপারেশন ঠিকই হয়েছে, তবে মিসেস সরকারকে তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।
তিন মাস শুয়ে থাকতে হবে?
একটা ফরেন বডি হাড়ের মধ্যে ঢুকিয়েছি।
দু’জায়গার হাড় জোড়া লাগতে ছ’ থেকে আট সপ্তাহ সময় লাগবে; তাছাড়া স্টীল রড় দুটো ঠিক মতো ফিক্সড হওয়া চাই।
এর আগে ওর ভাল হবার সম্ভাবনা নেই?
ওষুধপত্তর ঠিক মতো খাওয়াবেন; গড উইলিং একটু তাড়াতাড়ি কন্ডিসন ইমপ্রুফ করতে পারে। দু’মাস পরে একবার এক্স-রে করে দেখব কি অবস্থা।
বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে অনুপমা ওর ছেলেকে নিয়ে নার্সিংহোমে যায়। বাবুসোনা মাকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। মনিকা একবার ছেলেকে বুকের উপর নিয়ে আদর করতেই নার্স বলেন, ম্যাডাম, ছেলেকে ফিরিয়ে দিন। সামান্য একটু টান লাগলেই অপারেশনের জায়গার স্টিচ ছিঁড়ে যেতে পারে।
নে অনু, ছেলেকে ধর।
হ্যাঁ, অনুপমা ওর ছেলেকে কোলে তুলে নেয়।
দিন দশেক পর মনিকা অনুপমাকে দেখিয়ে ছেলেকে বলেন, বাবুসোনা, এই মা কেমন?
মা ভাল, ভাল মা ভাল।
ব্যস, অনুপমা ওর সারা জীবনের জন্য ভাল মা হয়ে গেল।
৩-৪. রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কারেন্সী অফিসার
অপুর্ববাবু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কারেন্সী অফিসার আর বিমলবাবু আশুতোষ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। সপ্তাহের ছ’দিনই দু’জনকে ব্যস্ত থাকতে হয়। একটু ঢিলেঢালা আয়েষী দিন কাটাবার সুযোগ শুধু রবিবার। দু’জনেরই ঘুম ভেঙে যায় ভোরবেলায় কিন্তু দুজনেই গড়িমসি করে বিছানা ছাড়েন দেরি করে।
কিগো, বিছানা ছেড়ে উঠবে না নাকি? চটপট উঠে পড়ে মুখ ধুয়ে নাও; আর দেরি করলে চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, উঠছি।
অনুপমা ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলেন, তুমি চা খেয়ে বাজার যাবে