মৌ একটু থেমেই বলে, দশ হাজার কোটি টাকার যত বেশি টাকা বাজারে ছাড়বে তত বেশি মুদ্রাস্ফীতি হবে অর্থাৎ পাঁচ পার্সেন্ট বেশি টাকা বাজারে ছাড়লে পাঁচ পার্সেন্ট মুদ্রাস্ফীতি…দশ পার্সেন্ট বেশি টাকা ছাড়লে দশ পার্সেন্ট ইনফ্লেশন হবে।
ডরোথী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, এবার ব্যাপারটা বেশ পরিষ্কার হল।
.
প্রতিদিন কলেজে শত শত প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর সদ্য যৌবনা মেয়ের মাঝখানে কাটিয়ে মৌ রোজ খুশি মনেই বাড়ি ফেরে। সব ছাত্রীদের হাসি মুখ দেখতে দেখতে মৌ-এর মুখেও হাসি ফিরে আসে, আনন্দ ফিরে আসে।
তবে কলেজের ছুটি হলে মৌ কিছুতেই বাড়ির মধ্যে বন্দিনী হয়ে থাকতে পারে না; বেরিয়ে পড়ে কোথাও না কোথাও। কখনো দার্জিলিং, কখনো পুরী, কখনো শিলং বা কোদাইকানাল, কখনো জৈসালুমের যোধপুর-উদয়পুর-জয়পুর সিমলা-ডালহৌসী।
এইভাবেই কেটে যায় বছরের পর বছর।
.
কলেজ ছুটি হবার দু’চারদিন আগে রাধা মৌ-কে বলে, এবার ছুটিতে কোথায় যাবে ঠিক করেছ?
মাসি, এবার ঠিক করেছি, পুরো ছুটিটাই-হরিদ্বারে কাটাব।
হরিদ্বারে?
হ্যাঁ, হরিদ্বারে।
তুমি তো পুরো ছুটি কখনই এক জায়গায় কাটাও না, তুমি তো চড়ুই পাখির মতো উড়ে বেড়াও নানা জায়গায়।
মৌ একটু হেসে বলে, মাসি, বুড়ি হয়ে গেছি, এই বয়সে আর পাঁচ জায়গায় ঘুরে না বেড়িয়ে হরিদ্বারেই…
তুমি বুড়ি হয়েছ?
তবে কী আমি কচি খুকি?
রাধা একগাল হেসে বলে, তোমাকে দেখে কেউ বলবে না তোমার বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি।
কী পাগলের মতো কথা বলছ?
সত্যি বলছি, তোমাকে দেখে কেউ বলবে না, তোমার তেত্রিশ-চৌত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। আজকাল তো বহু মেয়েই এই বয়সে বিয়ে করে।
সে যাইহোক, আমি এবার পুরো ছুটি হরিদ্বারেই কাটাব।
হ্যাঁ, তা কাটাও কিন্তু শরীরের দিকে খেয়াল রেখো।
মৌ শুধু হাসল।
.
রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লী; তারপর ইন্টারস্টেট বাস টার্মিনাস থেকে শেয়ারের ট্যাক্সিতে ডেরাডুন বাস স্ট্যান্ড। তারপর হরিদ্বারের বাসে উঠতে যাবার মুখেই দু’জনের দেখা।
বিস্মিত হয়ে দু’জনেই একসঙ্গে বলে, তুমি?
দু’জনের মুখেই হাসি।
মৌ একটু হেসে বলে, কলেজের ছুটি, তাই ছুটি কাটাতে হরিদ্বার যাচ্ছি কিন্তু তুমি?
শান্ত একটু হেসে বলে, আমি তো হরিদ্বারেই থাকি।
হরিদ্বারে?
হ্যাঁ, হরিদ্বারে।
তুমি চাকরি করছ না?
না, অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছি।
শান্তর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটিকে দেখিয়ে মৌ জিজ্ঞেস করে, ও কে?
আমার মেয়ে।
তোমার মেয়ে?
হ্যাঁ, আমার মেয়ে।
শান্ত মেয়েটির মুখ আলতো করে তুলে ধরে বলে, মাগো, আমি তোমার বাবা না?
হ্যাঁ, তুমি আমার বাবা।
মৌ বলে, তুমি বিয়ে করলে কবে?
শান্ত একগাল হেসে বলে, বিয়ে তো বহুকাল আগেই করেছি।
তোমার বউ কোথায়? হরিদ্বারে?
সে আমার সঙ্গে থাকে না।
কেন?
শান্ত আবার একটু হেসে বলে, সে প্রায় বছর দশেক আগেকার কথা। একদিন একটু মতবিরোধ হল বলে এক রবিবার খুব ভোরে আমাকে কিছু না বলেই…
এবার মেয়েটি বলে, বাবা ইনি কে?
মাগো, ইনি তোমার মা; তুমি মাকে প্রণাম করো।
পার্বতী প্রণাম করতেই মৌ দু’হাত দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে স্নেহচুম্বন দেয়।
মৌ শান্তকে জিজ্ঞেস করে, এমন সোনার টুকরো মেয়েকে পেলে কোথায়?
দেবতাত্মা হিমালয় জুটিয়ে দিয়েছেন বলেই তো ওর নাম রেখেছি পার্বতী।
প্লীজ বল না, কী করে ওকে পেলে।
.
শান্ত একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, চাকরি ছেড়ে বেশ মোটা টাকা পেলাম; তাছাড়া বাবা মায়ের জন্য যে ইন্সিওরেন্স করেছিলেন, তার টাকা ব্যাঙ্কেই পড়েছিল বহুদিন। এই সব টাকা পাবার পর হরিদ্বারে এসেই গঙ্গার ধারের একটা কমপ্লেক্সে একটা সুন্দর দু’কামরার ফ্ল্যাট কিনলাম।
তারপর?
প্রথম দু’এক মাস বেশ কাটল, তারপর আর একলা থাকতে ভাল লাগছিল না বলে রোজই এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতাম।
শান্ত একটু হেসে বলে, সেদিন হৃষিকেশে গঙ্গার ধারে চুপচাপ বসেছিলাম। হঠাৎ পাঁচ-ছ’ বছরের একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে এসে বলল, বাবা, বড্ড খিদে লেগেছে; আমাকে কিছু খেতে দেবে?
তারপর?
ওকে খাইয়ে আবার ওকে নিয়ে গঙ্গার ধারে বসে ওর মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করি।
ও কী বলল?
বলল, গত কুম্ভমেলার সময় ও মা-বাবার সঙ্গে হরিদ্বারে এসেছিল। চার-পাঁচ দিন পরই ওর বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয় ও দু’তিন দিন পরই মারা যায়।
ওর বাবার কী হয়েছিল?
বোধহয় কলেরা।
তারপর?
ওর মা কান্নাকাটি করতে করতে ছুটে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল।
বেরিয়ে কোথায় গেল?
তারপর ও আর মায়ের দেখা পায়নি।
শান্ত চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বেচারা বছর দুয়েক কান্নাকাটি করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে আর কোনমতে ভিক্ষা করে বেচে থেকেছে।
তারপর তোমার সঙ্গে দেখা?
হ্যাঁ।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, দুটো কাগজে ওর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম, তারপর কোর্ট-কাছারি করে ওকে আমি আডপ্ট করলাম আর নাম দিলাম পার্বতী।
এই কাহিনী শুনে খুশিতে মন ভরে যায় মৌ-এর। একটু থেমেই বলে, তোমরা ডেরাডুনে এসেছ কেন?
শান্ত একটু হেসে বলে, মা জননীকে এখানকার একটা খুব ভাল স্কুলে ভর্তি করেছি। ও থাকে হস্টেলেই। তবে শনি-রবিবার ছুটি বলে শুক্রবার বিকেলে আমি ওকে নিয়ে যাই আবার সোমবার ভোরের বাস ধরে ওকে হস্টেলে পৌঁছে দিই।