সোমবার অফিসে গিয়েই শান্ত জানতে পারে, মৌ চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।
.
মৌ শূন্য মন নিয়ে শূন্য বাড়িতে ফিরে এল।
বাবাকে হারিয়ে মনে হয়েছিল যেন মাথার উপর এক আস্ত পাহাড় ভেঙে পড়ল; মাকে হারিয়ে মনে হল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। তারপর? শেষ পারানির কড়ি শান্তদা।
শৈশব, কৈশোরের প্রাণের বন্ধু, প্রথম যৌবনে যাকে ভালবেসে, যার ভালাবাসা পেয়ে মনে-প্রাণে রামধনুর রঙে রাঙিয়ে উঠেছে, সেই শান্তদাকে বহুদিন পরে যৌবনের ভরা জোয়ারে পেয়ে উত্তাল আনন্দে দু’জনেই ভেসে গিয়েছি তাজ হোটেলের স্বপ্নময় পরিবেশে।
আর কী?
জীবনে প্রথম একটা বিচিত্র আনন্দঘন পূর্ণতার স্বাদ পায় মৌ।
আর শান্ত?
সে বাবাকে হারিয়েছে, হারিয়েছে মাকে আর তারপর থেকেই নিঃসঙ্গতার জ্বালায় জ্বলেপুড়ে মরেছে। মৌকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তার অশান্ত মন শান্ত হয়েছে।
মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে দু’জনে দু’জনের হাত ধরে দু’জনেই ভবিষ্যতের আনন্দময় দ্বৈত জীবনের স্বপ্ন দেখেছে। রহস্যময় মধ্যরাত্রির অন্ধকারে দুটি প্রাণ যেন দরবারী কানাড়ার সুরের যাদুতে আন্দোলিত হয়।
তারপর?
বোধনেই হঠাৎ বিসর্জনের বাজনা বেজে ওঠে।
মৌ-এর মনপ্রাণ হঠাৎ জ্বালা করে ওঠে। শূন্য মন, শূন্য দৃষ্টি। সামনে যেন সব অন্ধকার।
.
কী হল মৌ? খেতে এসো। সব যে ঠান্ডা হয়ে গেল।
রাধা মাসি আপন মনেই বলে, তিন তিনবার তোমাকে ডেকে গেলাম, তা কি তোমার কানে যায়নি?
হ্যাঁ, মাসি আসছি।
মৌ খেতে বসতেই রাধা বলে, কাজকর্ম না করে সারাদিন বাড়িতে বসে কি যে ভাবো তা তুমিই জানো। তাছাড়া চব্বিশ ঘণ্টা বাড়ির মধ্যেই বা বসে থাক কেন? তোমার তো কম বন্ধুবান্ধব নেই; তাদের কাছে গেলেও তো মন ভাল হয়।
মৌ ওর কথার কোন জবাব দেয় না। কী জবাব দেবে? চুপ করে থাকে।
মৌ বেশ বুঝতে পারে, বুকের মধ্যে একটু চোরা কুঠী আছে যেখানে মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রাণের মানুষ পাকপাকি আসন বিছিয়ে বসেন। কী আশ্চর্য! সেখানেও শান্তদা?
মৌ মনে মনে বলে, ‘নয়ন ছেড়ে চলে গেলে। এলে সকল মাঝে/তোমায় আমি হারাই যদি/তুমি হারাও না যে..’। কী আশ্চর্য মানুষের মন? যাকে হারাতে চাই, সে কিছুতেই হারিয়ে যায় না। যাকে শত যোজন দূরে ফেলে এসেছি, সেই মনের পর্দায় অহরহ ভেসে ওঠে।
তাইতো ওর বলতে ইচ্ছা করে ‘মনে রবে কি না রবে সে আমার মনে নাই।/ক্ষণে ক্ষণে আমি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই’।
আবার কোন কোনদিন মৌ সাত সকালে উঠেই মা-বাবার ঘরে এদিক-ওদিক ঘুরে দেখে। হঠাৎ একটা আলমারী খুলে বাবার জামা-কাপড়গুলোতে হাত দেয়, গন্ধ শোঁকে। একটু হেসে মনে মনে বলে, জানো বাবা, তোমার জামাকাপড়ে এখনও তোমার গায়ের গন্ধ লেগে আছে।
তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতেই হঠাৎ একটা ছবি হাতে তুলে নিয়েই মৌ গলা চড়িয়ে বলে, ও মাসি, শিগগির একটা জিনিষ দেখে যাও।
রাধা ঘরে ঢুকেই বলে, ডাকছ কেন?
এই ছবিটা দেখ।
রাধা মাসির হাতে ছবিটা দিয়েই হাসতে হাসতে বলে, আমি যেদিন প্রথম শাড়ি পরে স্কুলে যাই, সেদিন বাবা আমার এই ছবি তোলেন।
তাই নাকি?
মাসি, বাবা সেদিন কি বলেছিলেন জানো?
কী বলেছিলেন?
বলেছিলেন, তোক দেখতে ঠিক আমার মায়ের মতো লাগছে।
আচ্ছা!
হ্যাঁ, মাসি।
সে মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, বাবা সত্যি আমাকে মায়ের মতো ভালবাসতেন। তাইতো বাবা আমাকে কখনও ডাকতেন ‘মৌ মা’ বলে, কখনো আবার ‘মাদার’ বা জননী’ বলে।
রাধা হাসতে হাসতে নিজের কাজে চলে যায়।
মৌ সেদিন নিজের ঘরে বসেই হঠাৎ একটা পুরনো দিনের অ্যালবাম হাতে তুলে নিয়ে কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে দেখার পরই একটা ছবি দেখে আপন মনেই বলে, তখন আমার বয়স কত? এগারো না বারো।
সেদিনের ঘটনা মৌ জীবনেও ভুলবে না; অথচ সেদিনের কথা মনে হলেই হাসি পায়।
.
সেদিন রবিবার।
মৌ বাথরুমে যাবার আগে প্রায় চিৎকার করে বলে, মা, আমি বাথরুমে যাচ্ছি; আমার দেরি হবে। ডাকাডাকি করো না।
দেরি হবে কেন?
অন্যদিন স্কুল থাকে বলে তো ভাল করে চান করতে পারি না; আজ সাবান মেখে ভাল করে চান করব, শ্যাম্পু করব। দেরি তো হবেই।
বেশি দেরি করিস না।
মৌ সে কথার জবাব না দিয়েই বাথরুমে ঢুকে যায়।
মিনিট দশেক পরের কথা।
হঠাৎ মৌ আতঙ্কে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো চিৎকার করে, ও মা, শিগগির এসো, আমি আর বাঁচব না।
মনিকা দেবী প্রায় দৌড়ে বাথরুমে যান।
মৌ কাঁদতে কাঁদতেই বলে, ও মা আমার পেট থেকে কি রক্ত বেরুচ্ছে! দু’পা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
মনিকা দেবী একটু হেসে বলেন, তোর কিছু হয়নি; সব মেয়েদেরই এইরকম হয়। তুই সত্যি বড় হয়ে গেলি।
.
তারপর?
বিকেলের দিকে শান্ত আসতেই সেই ইসতে হাসতে বলে, জানো মা আজ আমাকে কী বলেছে?
ভাল মা কী বলেছে?
বলেছে, আমি বড় হয়ে গেলাম।
তার মানে?
তার মানে তাই।
ভাল মা হঠাৎ ও কথা বলল কেন?
মৌ একটু হেসে বলে, সে তুমি বুঝবে না।
আমি বুঝব না?
না।
কেন?
আমি অত-শত জবাব দিতে পারব না। আসল কথা হচ্ছে, কোন ছেলেকেই বলতে পারব না, মা কেন ও কথা বলেছে।
মৌ, প্লীজ আমাকে বল।
মৌ দুহাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে দু’গালে আলতো করে চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে বলে, মাই ডিয়ার শান্তদা, তোমাকেও সে কথা বলা যাবে না।
বাড়ির মধ্যে ঘুরাঘুরি করতে করতে আরো কত কথা মনে হয়।