এইভাবেই বিমলবাবুর মৃত্যুর পর তিন মাস কাটলো।
.
সেদিন শনিবার।
সকালের ফ্লাইটে শান্ত এসেছে। ও অনুপমা দেবীকে জড়িয়ে ধরে একটু হেসে বলে, ভাল মা, আমি এলে তোমার ভাল লাগে?
অনুপমা দেবীও একটু হেসে খুব আস্তে আস্তে বলেন, খুব ভাল লাগে।
ঠিক সেই সময় ডা. চ্যাটার্জী এলেন।
শান্তকে দেখেই উনি বলেন, তুই কখন এলি?
একটু আগে এসেছি।
আর কথা না বাড়িয়ে ডা. চ্যাটার্জী অনুপমা দেবীকে পরীক্ষা করে ঘরের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সিস্টার বলেন, স্যার, কিছু ওষুধ চেঞ্জ করবেন নাকি?
কোর্স শেষ হয়েছে?
স্যার, আরো দুদিনের ওষুধ আছে।
এই কোর্স শেষ হবার পর চেঞ্জ করব।
ডা. চ্যাটার্জী ঘরের বাইরে যেতেই শান্ত বলে, জ্যেঠু, ভাল মা-কে কেমন দেখলেন?
মৌ-এর কাঁধে একটা হাত রেখে উনি বলেন, তোর ভাল কাকা মারা যাবার পরও যে তার পাশে শুয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন, সেই অপরাধ বোধের ব্যাপারটা ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
হ্যাঁ, জ্যেঠু, ঠিক বলেছেন।
মন থেকে যদি এই অপরাধবোধ না চলে যায়, তাহলে ওর শারীরিক উন্নতি হওয়া খুবই কঠিন।
ডা. চ্যাটার্জী চলে যেতেই মৌ আর শান্ত ঐ ঘরে ফিরে যায়।
সিস্টার ওদের বলেন, মাসিমা, অনেকক্ষণ শুয়ে আছেন; এবার ওকে একটু উঠে বসাব।
আমি ওকে উঠে বসাচ্ছি।
কথাটা বলেই শান্ত ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বসিয়ে দিতেই অনুপমা দেবী ওরই গায় হেলান দেন। সিস্টার ওকে একটু দুধ খাওয়াতে যেতেই মৌ ওর হাত থেকে দুধের গেলাস আর চামচ নিয়ে নিজেই মা-কে একটু একটু করে দুধ খাওয়ায়।
দু’তিন চামচ দুধ খাওয়ার পরই অনুপমা দেবী হঠাৎ বেশ খানিকটা বমি করেই দু তিনবার হিক্কা তুলে এক হাত দিয়ে মেয়ের হাত ধরে শান্তর গায়ের পর ঢলে পড়েন।
মৌ গলা চড়িয়ে বলে, মা, ও মা, কী হয়েছে?
শান্ত দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে বলে, ভাল মা, বল, কী কষ্ট হচ্ছে?
সিস্টার সঙ্গে সঙ্গে ওকে শুইয়ে দেয়।
রাধা মাসি ছুটে গিয়ে ডা. চ্যাটার্জীকে ডেকে আনে।
ডা. চ্যাটার্জী ওর পালস দেখেই কানে স্টেথো দিয়ে চেস্ট পিস দিয়ে বুক পরীক্ষা করেই বলেন, সরি, সী ইজ নো মোর।
.
পুরো এক মাস ছুটির পর মৌ বোম্বে এসেছে পাতিল সাহেবের তলব পেয়ে; তবে ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে শান্তর সঙ্গে জরুরী কথাবার্তা বলবে বলে সোমবারের বদলে শনিবার সকালের ফ্লাইটেই এসেছে।
সারাদিন দু’জনেই আনন্দে খুশিতে কাটাবার পর সন্ধের সময় ব্যালকনিতে পাশাপাশি বসেই মৌ বলে, শান্তদা, এবার তো আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে।
হ্যাঁ, তা তো ভাবতেই হবে।
বল, কবে আমাদের বিয়ে হবে।
বলব, বলব।
একটু চুপ করে থাকার পর শান্ত বলে, তুই আমার মায়ের গুরুদেবকে দেখেছিস?
হ্যাঁ, একবার দেখেছি।
কবে?
হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা শেষ হবার কদিন পর।
ওকে তোর কেমন লেগেছিল।
অসম্ভব ভাল; দেখলেই মাথা নুয়ে আসে। তাছাড়া ওর চোখের দিকে কিছুতেই তাকানো যায়
শান্ত বলে, উনি খুবই বড় সাধক ছিলেন।
সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
কী করে বুঝলি?
মৌ একটু হেসে বলে, উনি আমাকে দেখেই বলেছিলেন, বেটি, তুই এম. এ পাস করেই খুব বড় চাকরি পাবি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, শান্তদা।
শান্ত একটু হেসে বলে, আমি যখন মা-র পেটে মাত্র ছ’মাসের তখনই উনি মাকে দেখে বলেছিলেন, তুই তো ছেলের মা হতে যাচ্ছিস।
হ্যাঁ, আমি দু’মায়ের কাছেই এই কথা শুনেছি।
শান্ত উঠে দাঁড়িয়েই বলে, এবার ঘরে চল; তোকে মায়ের একটা চিঠি দেখাব।
হ্যাঁ, চল।
শান্ত ঘরে এসে আলমারীর লকার খুলে একটা চিঠি বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে, পড়ে দ্যাখ।
..স্নেহের শান্ত, তোকে একটা বিশেষ কথা জানাবার জন্যই এই চিঠি লিখছি। আমি আমার পরমপূজ্য গুরুদেবকে বলেছিলাম, বাবা শান্ত যদি আমার হৃৎপিণ্ড হয় তাহলে মৌ আমার চোখের মণি। মৌ আমার গর্ভে না জন্মালেও ও আমার মেয়ে, আমি ওর মা। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই শান্ত আর মৌ-এর ভাব-ভালবাসা; ওরা যত বড় হয়েছে, তত গম্ভীর হয়েছে। ওদের ভালবাসা। আপনি দয়া করে অনুমতি দিলে আমি ওদের বিয়ে দিতে চাই।
গুরুদেব দু’এক মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকার পর বললেন, আনুষ্ঠানিক বিয়ের তিন মাসের মধ্যে তোর মৌ বিধবা হবে; তবে আনুষ্ঠানিক বিয়ে না করে ওরা যদি শুধু মালাবদল করে একসঙ্গে জীবনযাপন করে তাহলে ওদের কোন অমঙ্গল হবে না।…
চিঠিটা পড়ে মৌ যেন বাকরুদ্ধ হয়; আপন মনে শুধু আকাশ-পাতাল চিন্তা করে।
শান্ত এক হাত দিয়ে আলতো করে ওকে ধরে বলে, আমরা মালাবদল করেই একসঙ্গে জীবন কাটিয়ে দেব।
মৌ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলে, না, শান্তদা তা হয় না।
কেন?
আমি সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে সবাইকে বলতে চাই, আমি তোমার স্ত্রী, তুমি আমার স্বামী।
আমরা একসঙ্গে থাকলেও তো সবাইকে সেই পরিচয় দেওয়া হবে।
আমি বালির উপর স্বপ্নের প্রাসাদ গড়তে চাই না।
বালির উপর প্রাসাদ গড়বি কেন? আমি কথা দিচ্ছি, জীবনেও কোনদিন তোর অমর্যাদা করব না।
আমি রক্ষিতার মতো জীবন কাটাতে চাই না।
না, শান্ত আর একটাও কথা বলে না; নীরব থাকে মৌ-ও।
খাওয়া-দাওয়া করে দু’জনেই শুতে চায় কিন্তু মাঝখানে অনেক দূরত্ব থাকে।
অন্যান্য রবিবারের মতো শান্ত দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে কিন্তু ফ্ল্যাটের কোথাও মৌ-কে দেখে না। ও মনে মনে ভাবে, মৌ হয়তো কোন হোটেলে চলে গেছে।