কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করবেন অথচ ঠিক মতো রিপোর্ট তৈরি করবেন না, তা চলবে না।
মৌ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আজকের মধ্যেই রিপোর্ট…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ম্যাডাম, আজই রিপোর্ট রেডি হয়ে যাবে।
হলেই ভাল; তা না হলে তো পরের সপ্তাহে সাপ্লাই আটকে যেতে পারে। আচ্ছা নমস্কার।
কথাটা শুনেই মি. জালানের মুখ শুকিয়ে যায়; তবু বলেন, নমস্কার!
বেশি না, তিনজন ডিস্ট্রিবিউটার আর এজেন্টদের কাছে যেতেই দিকে দিকে বার্তা রটে গেল ক্রমে।
.
জানেন পাইনদাদা, নতুন ম্যাডাম বড় কড়া অফিসার আছেন। কাজের কথা ছাড়া একটাও অন্য কথা বলেন না। তাছাড়া ঠিক মতো রিপোর্ট না পেলেই পরের সপ্তাহে সাপ্লাই বন্ধ হতে পারে বলেন।
বলেন কী? এই মহিলাকে তো ঠাণ্ডা করার দরকার।
কি যে বলেন দাদা? উনি এক কাপ চা-কফি পর্যন্ত খান না; অন্য কিছু করতে গেলে হয়তো আমরা ব্ল্যাক লিস্টেড হব।
তাহলে তো সত্যি চিন্তার ব্যাপার।
দেখছি, রিপোর্ট তৈরির জন্য একটা আলাদা লোক রাখতেই হবে।
তাহলে আমিও রিপোর্ট তৈরির জন্য একটা লোক রাখি, কি বলেন?
মি. জালান একটু হেসে বলেন, আমরা যখন বছরে প্রায় কোটি টাকা প্রফিট করি, তখন একটা নতুন লোক রাখার জন্য বছরে অন্তত ছত্রিশ হাজার খরচ করতে আপত্তি কী?
না, না, আপত্তির কিছু নেই।
বেশি দিন না, মাস খানেকের মধ্যেই কোম্পানী বুঝতে পারলো, গ্রেটার ক্যালকাটা এরিয়ায় বিক্রি বাড়ছে। শান্তও টেলিফোন করে জানালো, মৌ, তুই জয়েন করার পর থেকেই বিক্রি বাড়ছে বলে মি. পাতিল খুব খুশি।
.
মৌ চাকরি পাওয়ায় সংসারের চেহারাও বদলে গেল। যে রাধা মাসি বরাবর আনাজ কাটা আর রাত্রে খাবার জন্য রুটি-তরকারি করতো, সে এখন দিনেও রান্না করে। মেয়ের তাগিদেই বিমলবাবু আর অনুপমা দেবী রোজ বিকেলে সাদার্ন এভিন্যুতে বেড়াতে যান। হাজার হোক সারাজীবন অধ্যাপনা করেছেন বলে বিমলবাবু বরাবরই পড়াশুনা করে সময় কাটান। মাসে দু’বার গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরী থেকে তিনটে করে বই আনেন পড়ার জন্য। আগে সংসারের কাজকর্মের জন্য অনুপমা দেবী শুধু খবরের কাগজ পড়তেন; অন্য বইটই পড়ার সময় পেতেন না। এখন তার অনেক সময়, তাইতো আবার আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ পড়া শুরু করেছেন।
শুধু তাই না।
কত আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ আসে বিমলবাবুর কাছে; কখনও কোন পুরনো সহকর্মীর নাতি-নাতনীর বিয়ে, আবার কখনো প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে। আমন্ত্রণ আসে অন্যান্য কারণেও; কখনো কারুর গৃহপ্রবেশ বা বিয়ের পঁচিশ-পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে। এইসব ধারে-কাছে হলে সস্ত্রীক বিমলবাবু সেই সব নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেও একটু দূরে হলেই অক্ষমতা জানাতেন।
এখন?
মৌ গাড়ির ব্যবস্থা করে বলে পুরনো দিনের প্রিয় ছাত্রী শীলার মেয়ের বিয়েতে নৈহাটি যেতেও দ্বিধা করলেন না বা পুরনো সহকর্মী দ্বিজেনবাবুর নাতির পৈতে উপলক্ষে শ্রীরামপুর ঘুরে এলেন।
এইভাবেই কেটে গেল তিনটে মাস।
.
দিন পনের পরের কথা; হঠাৎ মিসেস যোশীর ফোন।
মহুয়া, আমি মিসেস যোশী বলছি।
মৌ একটু হেসে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন।
পাতিল সাহেব আপনাকে এই সপ্তাহের মধ্যেই দেখা করতে বলেছেন।
উনি হঠাৎ দেখা করতে বলছেন কেন?
তা আমি জানব কেমন করে।
মিসেস যোশী মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, স্যার হয়তো জানেন, কেন পাতিল সাহেব আপনাকে দেখা করতে বলেছেন; আপনি স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন?
হ্যাঁ, দিন।…
শান্ত রিসিভার তুলেই বলে, বল, মৌ, কী খবর?
দিদি বললেন, পাতিল সাহেব আমাকে এই সপ্তাহেই দেখা করতে বলেছেন।
হ্যাঁ, দিদি ঠিকই বলেছেন।
কিন্তু কেন?
তা বলতে পারব না, তবে এইটুকু বলতে পারি, উনি তোর কাজে খুবই সন্তুষ্ট।
মৌ একটু থেমেই বলে, ওখানে ক’দিন থাকতে হবে, তা কী উনি বলেছেন?
আমাকে উনি শুধু বলেছেন, তোকে খবর দিতে আর বলেছেন, কয়েক দিন সময় হাতে নিয়ে আসতে।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, তুই কবে আসতে পারবি?
বুধবারের আগে পারব না।
আমি কী পাতিল সাহেবকে বলব, তুই বুধবার আসবি?
হ্যাঁ, বলতে পারো।
তুই কোন ফ্লাইটে আসছিস জানলে আমি এয়ার পোর্টে তোকে রিসিভ করব।
আমি কালকেই তোমাকে জানিয়ে দেব।
ঠিক আছে।
.
শান্তর সঙ্গে ওকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মি. পাতিল এক গাল হেসে বলেন, ইয়েস মিস চৌধুরী, ওয়েলকাম টু আওয়ার হেড অফিস।
মৌ না হেসে পারে না।
বসুন, বসুন।
ওরা দু’জনে সামনের চেয়ারে বসতেই মি. পাতিল বলেন, মিস চৌধুরী, আগে বলুন, কেমন আছেন।
স্যার, ভাল আছি।
আমাদের কাজ করতে কেমন লাগছে?
স্যার, বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে।
দ্যাটস্ ভেরি গুড।
মি. পাতিল একটু থেমেই হাত দিয়ে শান্তকে দেখিয়ে বলেন, মি. সরকার ইস্টার্ন রিজিয়নের গত মাসের যে রিপোর্ট আমাকে দিয়েছেন, তা দেখে বুঝলাম, আপনার এরিয়ায় ভালই সেলস্ বেড়েছে।
হ্যাঁ, স্যার, একটু বেড়েছে।
মি. পাতিল একটু হেসে বলেন, আপনি যাকে একটু বেড়েছে বলছেন, আমাদের কাছে তা ভেরি পজিটিভ সাইন।
উনি একবার নিশ্বাস নিয়েই বলেন, আমরা চাই, আপনাকে আরো একটু দায়িত্ব দিতে।
স্যার, যদি পরিষ্কার করে বলেন, তাহলে ভাল হয়।
আমরা চাই, আপনি প্লীজ নর্থ বেঙ্গল আর সিকিমেরও দায়িত্ব নিন।
স্যার, আমি কী এত দায়িত্ব নেবার উপযুক্ত?