স্যার, যাস্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
হ্যাঁ, বলুন।
আমাদের দেশে এমন শহর আছে, যেখানে সব চাইতে কম দামী আইসক্রীম বিক্রি হয় নব্বই টাকায়, প্রত্যেকটি বাড়ির কাজের মেয়ের মোবাইল ফোন আছে আর লাখ দুয়েক টাকা সেলামী ছাড়া পঁচিশ হাজার টাকার কমে অত্যন্ত সাধারণ এলাকায় দু’ঘরের বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না, সেখানে কী এক টাকা বা দু টাকা দামের শ্যাম্পুর পাউচ বিক্রি করার প্ল্যান করা উচিত?
লাভলি।
মি. পাতিল সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বললেন, শান্ত, আপনি সত্যি একটা ভাল মেয়েকে সিলেক্ট করেছেন। এই মেয়েকে আমরা কখনই মাসে মাসে মাত্র পনের হাজার দিতে পারি না; উই মাস্ট পে হার অ্যাটলিস্ট টোয়েন্টি ফাঁইভ থাউজ্যান্ড…
মৌ সঙ্গে সঙ্গে বলে, স্যার, প্লীজ আগে দেখুন আমি কাজ করতে পারি কিনা; তারপর না হয়..
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মি. পাতিল বলেন, আজ আমি বলে দিচ্ছি, ভবিষ্যতে আপনি হয়তো আমাদের কোম্পানীর ডাইরেক্টর হবেন।
.
বাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই শান্ত মৌ-কে কোলে তুলে নিয়ে দু’চার পাক চক্কর দিয়েই দু’হাত দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে দীর্ঘ চুম্বন দেয়।
মৌ শুধু হাসে।
তোর কথা শুনে মি. পাতিল প্রায় হিপনোটাইজড হয়েছিলেন।
মৌ দু’হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, সবই তো তোমার জন্য; দেখছি, তুমি আমার পরশ পাথর। তোমার ছোঁয়াতেই সব সোনা হয়ে যাচ্ছে।
আসলে তুই হচ্ছিস, সোনার টুকরো মেয়ে; এবার থেকে তুই শুধু এগিয়ে যাবি।
তুমি কী জ্যোতিষ যে এই কথা বলছ?
জ্যোতিষ কেন হব? তুই দেখিস, আমার কথা বর্ণে বর্ণে ফলতে বাধ্য।
মৌ ওর দুটো হাত ধরে বলে, শান্তদা, আমি তোমার পিছনে থাকতে পারলেই সুখী হব।
একটু পরই ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে বাঈ আসতেই মৌ জিজ্ঞেস করে, ব্যাগে কী আছে?
তোমাদের সংসারের জিনিসপত্র নিয়ে এলাম।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, বাঈ, ভুলে যেও না, আমার মা এই সংসারের ভার তোমার হাতে তুলে দিয়েছেন; এই সংসার তোমার।
এখন তোমার বউ এসেছে; এখন এই সংসার সে চালাবে।
মৌ বলে, বাঈ, আমি কখনই সংসার চালাতে পারব না; তুমি যেমন সংসার চালাচ্ছো সেইরকমই চালাবে।
আমার বয়স হচ্ছে না?
তুমি এখনো একশ’ বছর বাঁচবে।
কথাটা বলেই শান্ত হো হো করে হেসে ওঠে।
বাঈ একটু হেসে মৌ-কে বলে, বউ, এবার তোমার স্বামী আমার হাতে মার খাবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাঈ, তুমি সত্যি ওকে মারো তো; ওকে শাসন করা খুবই দরকার।
বাঈ আর কথা না বাড়িয়ে হাসতে হাসতে কিচেনের দিকে যায়।
মৌ আর শান্তও ওদের ঘরের দিকে যায়।
তারপর ওরা বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পোশাক বদলে ঘর থেকে বেরুতেই বাঈ বলে, তোমাদের খেতে দিয়েছি; গরম গরম খেয়ে নাও।
কী খেতে দিয়েছ?
বউ, তোমার স্বামী একই খাবার পর পর দুদিন খায় না; সাহেবের সবকিছু নিত্য নতুন চাই। তাই তো আজ দিয়েছি মোগলাই পরোটা।
মৌ হাসতে হাসতে বলে, ও আবার আমাকে বাতিল করে নতুন বউ আনবে না তো?
ও বহু ভাগ্য করে তোমার মতো বউ পেয়েছে, দেখব তো ওর কত বড় সাহস, তোমার বদলে নতুন বউ আনে।
.
ঘণ্টা বারো ডিউটি করে ক্লান্ত অবসন্ন অর্কদের বিশ্রাম করতে গিয়েছেন অনেক আগেই। আরব সাগরের আকাশে শুক্লা পঞ্চমীর এক টুকরো চাঁদ। চির চঞ্চলা মেরিন ড্রাইভ যেন পরমা সুন্দরী বাঈজীর মতো ঘাঘরা-চোলি
পরে গলায় এক গোছ মুক্তোর মালা জড়িয়ে নাচতে শুরু করেছে।
মেরিন ড্রাইভ সত্যি যেন মায়াবিনী উর্বশী-রম্ভা।
শান্তর কাঁধে মাথা রেখে মৌ বলে, তোমাদের এই মেরিন ড্রাইভে কি যেন রহস্য আছে; মনের মধ্যে কেমন যেন নেশা ধরে যায়।
হ্যাঁ, সত্যি বড় রোমান্টিক পরিবেশ; তাছাড়া এই সময় বারান্দায় বসে চারদিক দেখতে দেখতে সমস্ত পৃথিবীকেই ভালবাসতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, শান্তদা, ঠিক বলেছ।
.
দু’ এক মিনিট চুপ করে থাকার পর শান্ত আলতো করে মৌ-কে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে বলে, মা যখন বেশ অসুস্থ, তখনও এইরকম সন্ধের পর আমি মাকে বারান্দায় বসিয়ে বলতাম, মা, চারপাশ তাকিয়ে দেখো, পৃথিবী কি সুন্দর।…
ক্ষীণ কণ্ঠে মনিকা দেবী বলেন, হ্যাঁ, বাবা, সত্যি খুব সুন্দর।
মা, আমাদের সবার সৌভাগ্য যে আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে জন্মেছি, তাই না?
উনি শুধু একটু মাথা নাড়েন।
মা, আমরা সবাই অনেক অনেক দিন এই পৃথিবীতে থাকব, ভালভাবে থাকব, তাই না?
আবার সেই ক্ষীণ কণ্ঠে উনি বলেন, হ্যাঁ, সবাই ভাল থাকুক।
তুমিও ভাল থাকবে?
মনিকা দেবী খুব আস্তে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমার তো উপর থেকে ডাক এসে গেছে…
.
জানিস মৌ, ঠিক পরের দিনই মা চলে গেলেন।
কথাটা বলেই শান্ত কেঁদে ওঠে।
মৌ ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, কত ছোট ছোট বাচ্চারাও তো মা-কে হারায়; তোমার ভাগ্য ভাল বলে এত বছর ধরে মায়ের আদর ভালবাসা পেয়েছ। তাছাড়া কারুর মা-বাবাই তো চিরকাল বেঁচে থাকেন না।
শান্ত কোন কথা বলে না।
মৌ আবার বলে, তুমি কী জানো না, আমরা কেউই অমর না; আমাদের সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শান্ত বলে, মা চলে যাবার পর এই ফ্ল্যাটে আমি কিছুতেই একলা থাকতে পারছিলাম না। রাতের পর রাত আমি পায়চারি করে কাটিয়েছি।