না। শান্ত কথাটা শেষ করতে পারে না।
হঠাৎ সবাই চুপচাপ; কারুর মুখেই কোন কথা নেই।
একটু পরেই মৌ ও ঘরে এসে বলে, ও মা, খেতে দেবে না? বড্ড খিদে লেগেছে।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে ভাল, আমিও হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করে আসি নি।
হ্যাঁ, চল। তোদের দু’জনকে খেতে দিচ্ছি।
খেতে খেতেই শান্ত বলে, হ্যাঁরে মৌ, এখন কী করছিস?
মৌ হাসতে হাসতে বলে, এম. এ. আর রিসার্চ করার পর আমি ভগবান বুদ্ধের উন্নততর বামফ্রন্টের উন্নততর বেকার।
ওর কথায় শান্ত হো হো করে হেসে ওঠে।
বিমলবাবু ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, হ্যাঁ, ওর একটা চাকরি হলে বড়ই ভাল হত। গভর্নমেন্ট যেভাবে ইন্টারেস্ট রেট কমিয়েছে, তাতে আমার মতো রিটায়ার্ড লোকেরা সত্যি বিপদে পড়েছে।
মৌ বলে, শান্তদা, তুমি কোন হোটেলে উঠেছ?
তাজ বেঙ্গলে।
তার মানে ইউ আর রিয়েলি এ বিগ বস!
হঠাৎ আমার পিছনে লাগলি কেন?
সোজা কথা, আমাকে একটা চাকরি দাও।
সত্যি চাকরি করবি?
তবে কী তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি?
একটু চুপ করে থাকার পর শান্ত বলে, আমাদের চাকরিতে মাঝেমধ্যে বাইরে যেতে হবে, তাতে কোন আপত্তি নেই তো?
বাইরে মানে?
দু’চার মাস অন্তর আমাদের বোম্বের হেড অফিসে আসতে হবে। তাছাড়া তোকে মাসে একবার করে শিলং, গুয়াহাটি, গ্যাংটক, কাঠমাণ্ডু আর থিম্পু যেতে হবে।
মৌ বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে, রিয়েলি?
তবে কী আমি তোর সঙ্গে ঠাট্টা করছি?
ওইসব জায়গায় গিয়ে কোথায় থাকব?
ভাল হোটেলেই থাকবি।
মাইনে কত পাবো?
দুতিন শো’র কম হবে না।
শান্তর কথা শুনে বিমলবাবু আর অনুপমা দেবী হেসে ওঠেন।
মৌ বলে, অত টাকা মাইনে পেলে আমার মাথা ঘুরে যাবে।
যাইহোক তুই কী এখন আমার সঙ্গে যাবি?
তাজ-এ লাঞ্চ খাওয়াবে?
শুধু লাঞ্চ কেন, তোকে ডিনারও খাওয়াব।
এবার মৌ দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে, মা, যাব?
শান্তর সঙ্গে যাবি তা আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে।
মৌ হাসতে হাসতে বলে, শান্তদা একটু দাঁড়াও; একটু সেজেগুজে আসি।
প্রায় আধঘণ্টা পরে মৌ নীচে নেমে আসতেই শান্ত ওর চোখের পর চোখ রেখে বলে, মাই গড! তোকে কি দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে!
আমাকে সব সময়ই সুন্দর দেখায়।
তুই এত অহংকারী?
অহংকারের কী আছে? যা সত্যি তাই বললাম।
ভাল মা, ধন্য তোমার মেয়ে, ধন্য তার রূপ!
.
০২.
সে অনেক দিন আগেকার কথা।
পুজোর ছুটিতে লক্ষ লক্ষ বাঙালীর মতো ওরাও পুরী গিয়েছেন; উঠেছেন পুরী হোটেলেই। দুপুরে খেতে গিয়েই দেখা গেল, ওই দূরে কোনার দিকে একটা টেবিলই খালি আছে; আর সব টেবিলে আবাসিকরা খাওয়া-দাওয়া করছেন।
বিমলবাবু বললেন, অনু, চল, ওখানেই বসি।
একটা অল্পবয়সী ছেলে দুটো গেলাসে জল দিয়ে একটা জলের জাগ রেখে চলে গেল।
এখানে কী আমরা বসতে পারি?
বিমলবাবু আর অনুপমা তাকিয়ে দেখেন, প্রায় ওদের বয়সীই এক দম্পতি।
হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন।
বিমলবাবু একটু হেসেই বলেন।
ওদের দু’জনের মুখোমুখি বসেই মনিকা দেবী অনুপমা দেবীকে বলেন, আপনারা বোধহয় আমাদের পাশের ঘরেই আছেন, তাই না?
অনুপমা দেবী কয়েক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে তাকিয়েই একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, তাইতো। পাশের বারান্দায় আপনাদের দুজনকেই দেখি।
আমরাও তো আপনাদের দেখি।
ওরা চারজনেই না হেসে পারেন না।
আমি অপূর্ব সরকার আর আমার স্ত্রী মনিকা।
আমি বিমল চৌধুরী আর আমার স্ত্রী অনুপমা।
আমরা কলকাতায় থাকি; আপনারা কোথায় থাকেন?
আমরাও কলকাতায় থাকি।
এইভাবেই শুরু হল ওদের আলাপ পরিচয়।
খাওয়া-দাওয়ার পর ডাইনিং হল থেকে বেরিয়েই অপূর্ববাবু বলেন, মিঃ চৌধুরী, কলকাতায় আপনারা কোথায় থাকেন?
আমরা প্রতাপাদিত্য রোডে থাকি? আপনারা?
প্রতাপাদিত্য রোড শুনেই চৌধুরী হাসতে শুরু করেন।
কী হল? হাসছেন কেন?
আমরাও তো প্রতাপাদিত্য রোডে থাকি। তারপর?
দুটো বাড়ির নম্বর জানাজানির পর দেখা গেল, ওরা প্রায় সামনা-সামনি বাড়িতে থাকেন।
অনুপমা দেবী হাসতে হাসতে বলেন, আমরা থাকি দুটো মুখোমুখি বাড়িতে অথচ আমাদের আলাপ হল জগন্নাথ দেবের কৃপায় এই শ্রীক্ষেত্রে।
হ্যাঁ, ভাই, ঠিক বলেছেন।
মনিকা দেবী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, জগন্নাথ দেবের কৃপায় আমাদের যোগাযোগের ফল বোধহয় ভালই হবে।
বোধহয় না, নিশ্চয়ই ভাল হবে।
.
একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া গল্পগুজব করে ওদের সময় বেশ কেটে যায়।
কখনো অপূর্ববাবুর ঘরে বসে বিমলবাবু আড্ডা দেন। আবার কখনো অন্য ঘরে অনুপমা দেবী আর মনিকা দেবী গল্প করেন।
মনিকাদি, তোমরা ক’দিন এখানে থাকবে?
দশদিন।
উনি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, তোমরা কদিন কবে?
আমরা বারো দিন থাকব; তার মানে তোমাদের একদিন পরে কলকাতা পৌঁছব।
বারো দিনই পুরী থাকবে?
ইচ্ছা আছে দু’একদিন চিৎকার পাড়ে থাকার।
অনুপমা দেবী একটু হেসে বলেন, তোমরাও চিল্কা চল; খুব মজা হবে।
মনিকা দেবী একটু হেসে পেটের উপর হাত রেখে বলেন, সাত মাস; তাই এবার আর বিশেষ ঘুরাঘুরি করব না।
তাহলে তো তোমার ঘুরাঘুরি করা ঠিক হবে না।
সামনের বছর আমরা একসঙ্গে এসে খুব ঘুরব।
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
অনুপমা দেবী না থেমেই বলেন, তুমি যখন যেতে পারবে না, তখন আমরাও এবার চিল্কা যাব না।
আমার জন্য তোমরা কেন যাবে না? তোমরা ঘুরে এসো।
এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে যেতে পারব না।
কিন্তু…
না, না, কোন কিন্তু না। বেশ তো গল্পগুজব করে আমাদের দিনগুলো কাটছে।