মৌ-কে কবে যেতে হবে?
আমি ভাবছিলাম ওকে সঙ্গে নিয়েই যাব।
মৌ রাজি আছে?
ও তো এক পায়ে খাড়া।
ও রাজি থাকলে আমি আপত্তি করব কেন?
বিমলবাবু সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, তুই তোর ভাল মা-র সঙ্গেও এই ব্যাপারে কথা বলিস।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, ভাল মা-র সঙ্গে কথা বলেছি, তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।
তবে আবার কী? তবে দেখিস বোম্বের মত অচেনা শহরে ও যেন একা একা না ঘুরতে বেরোয়।
ওকে কখনই একলা ছাড়ব না; তেমন দরকার হলে আমাদের অফিসের কাউকে ওর সঙ্গে পাঠাব।
তাহলে তো ভালই হয়।
.
পরের দিন সকালে শান্ত হোটেল থেকে রওনা হয়ে এয়ারপোর্ট যাবার পথে মৌ-কে তুলে নিতে আসে। প্রণাম করে ভাল কাকাকে।
বিমলবাবু ওকে আশীর্বাদ করেই বলেন, তোকে কাছে পেয়ে ভরসা বেড়ে গেল; মাঝে মাঝেই একটু দেখে যাস।
হ্যাঁ, ভাল কাকা, নিশ্চয়ই আসব। এখন আপনারা দু’জন ছাড়া আমার আপনজন তো কেউ নেই।
শান্ত অনুপমা দেবীকে প্রণাম করেই ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, এখন তোমার চাইতে আপনজন আর কেউ নেই। তুমি যে কি ধাতুতে গড়া, তা ভগবানই জানেন। আমি তোমাকে যত বিরক্ত করি, তুমি তত আনন্দ পাও, তত খুশি হও।
শান্ত ওর হাতে একটা খাম দিয়েই গাড়িতে ওঠে।
.
মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে পৌঁছেই শান্ত টেলিফোন করে কলকাতায়।
ভাল কাকা, আমি শান্ত বলছি।
তোরা এর মধ্যেই পৌঁছে গেছিস?
হ্যাঁ, ভাল কাকা। মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে পৌঁছেই তো ফোন করছি। এবার মৌ-এর সঙ্গে কথা বলো।
হ্যাঁ, দে।
মৌ বলে, জানো বাবা, প্লেনে কি আনন্দেই এলাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, বাবা।
প্লেনে কিছু খেয়েছিস?
দারুণ খেয়েছি।
শান্তর ফ্ল্যাটটা কেমন?
ওয়ান্ডারফুল! অনেক দিনের পুরনো বাড়ি; তাই প্রত্যেকটা ঘরই হলঘরের মতো। তাছাড়া সব চাইতে ভাল হচ্ছে নীচে রাস্তার ঠিক পাশেই আরব সাগর ভাবাই যায় না।
যাইহোক সাবধানে থাকিস আর মাঝে মাঝে টেলিফোন করতে ভুলিস না।
না, না, ভুলব না।
এবার মা-র সঙ্গে কথা বল।
হ্যাঁ, দাও।
অনুপমা দেবী রিসিভার ধরেই বলেন, ভালভাবে পৌঁছেছিস?
হ্যাঁ, মা, খুব ভালভাবে এসেছি।
বোম্বে বিরাট শহর। একলা একলা কোথাও বেরুবি না।
শহরটা তো চিনি না; একলা বেরুব কোথায়?
এবার শান্তকে দে তো।
এই নাও।
হ্যাঁ, ভাল মা, বলো।
তুই আমাকে অতগুলো টাকা দিয়ে গেলি কেন?
বেশ করেছি।
অনুপমা হাসতে হাসতে বলেন, ওরে হতভাগা অতগুলো টাকা দিয়ে আমি কী করব?
যা ইচ্ছে।
তোর উপর আমার সত্যি খুব রাগ হয়েছে।
সামনের বার কলকাতা গেলে তুমি আচ্ছাসে আমাকে পিটুনি দিও। তাহলে তো হবে?
তোকে নিয়ে আমি কী করি বলতো?
আমাকে শুধু আদর করবে।
অনুপমা হো হো করে হেসে ওঠেন।
৮. মৌ জানলার ধারে
মৌ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সামনের আরব সাগর; কখনও কখনও দৃষ্টি গুটিয়ে এনে দেখছিল, মেরিন ড্রাইভ দিয়ে অজস্র গাড়ির ছোটাছুটি। কখনো কখনো এইসব দৃশ্য বিভোর হয়ে দেখতে আপনমনে হাসে।
সত্যি কত সিনেমায় এই দৃশ্য দেখেছি! আর আজ? আমিই সেই দৃশ্যের মুখোমুখি।
হঠাৎ শান্ত পিছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, কী দেখছিস?
মেরিন ড্রাইভের ওপাশেই আরব সাগর, সত্যি ভাবা যায় না। সত্যি ওয়ান্ডারফুল!
আর যে জড়িয়ে ধরেছে?
সে তো আমার আনন্দের মহাসাগর।
আর কিছু না?
সে আমার হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা, আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই একান্ত আমার।
সত্যি?
এক শ’বার সত্যি।
আমাকে দেখবি না?
আমি ঘুমের মধ্যেও তোমাকে দেখতে পাই, তা জানো?
শান্ত আলত করে ওর হাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসে ওকে কোলে বসিয়ে বলে, এখানে এসে তোর কেমন লাগছে?
এই স্বপ্নই তো দেখছিলাম বেশ কিছু দিন ধরে।
মৌ মুহূর্তের জন্য থেমে আলতো করে ওর ঠোঁটে ঠোঁট চুঁইয়ে বলে, সত্যি বলছি, এখনো যেন মনে হচ্ছে, স্বপ্ন দেখছি।
আমিও তোকে ছেড়ে আর থাকব না।
শান্ত বুক ভরে একবার নিশ্বাস নিয়ে বলে, সেই ছোটবেলা থেকে তুই ছিলি আমার একমাত্র খেলার সাথী আবার আমি ছিলাম তোর একমাত্র বন্ধু আর খেলার সাথী।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই।
আবার একটু বড় হবার পর থেকেই দু’জনের চোখেই রঙীন নেশা, রঙীন স্বপ্ন, তাই না মৌ?
তুমি ঠিক বলেছ।
মৌ না থেমেই বলে, স্কুল-কলেজে যাবার পথে যেসব ছেলেরা ভাব জমাবার চেষ্টা করতো, তাদের দেখলেই কি রাগ হততা! তুমি ছাড়া আর কোন ছেলেই আমার মনে দাগ কাটতে পারলো না।
তারপর?
এম. এ. পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক’টা বছর পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই হতো কিন্তু এম.এ. পরীক্ষা শেষ হবার পর তোমার কথা ভাবতে গেলেই নানা দুঃশ্চিন্তার জন্য মন খারাপ হতো।
কী দুশ্চিন্তা?
কখনো মনে হতো, তুমি কী আমাকে ভুলে গেলে। আবার কখনো সন্দেহ হতো, আচ্ছা শান্তদা কি অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করেছে…
আমি তো ভাবিনি, তুই অন্য ছেলেকে বিয়ে করে বেশ ভাল আছিস।
এখন তুমি যাই বলল, ক’বছর তুমি আমাদের তিনজনকে খুবই দুঃশ্চিন্তার মধ্যে রেখেছিলে।
শান্ত একটু হেসে বলে, ঐ অধ্যায়টা বাদে এখন বল, গত সপ্তাহটা তোর কেমন কেটেছে?
মৌ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলে, দারুণ! ফ্যানটাস্টিক।
তাই নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ও সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করে, লাস্ট উইক তোমার কেমন কেটেছে?
সে আর কি বলব? একটা মডার্ন উর্বশী আমার এতদিনের ব্রহ্মচর্য ব্রত ভঙ্গ করে দিলো!