শুধু কী তাই?
দিন দিন একদিকে হারাতে শুরু হল সাপ্লায়ের ব্যবসা, অন্যদিকে শুরু হল ব্যাঙ্কের টাকা মারা ও লুকিয়ে-চুরিয়ে সম্পত্তি বিক্রি আর দীর্ঘ মেয়াদী লিজ নেওয়া।
তারপর ছোট ভাই অমিত অন্য তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে শুরু করল মামলা।
.
বিমলবাবু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, বুঝলি শান্ত, আঠারো বছর ধরে মামলা চলার পর শেষ হল হাইকোর্টের রায়-এ। এই রায়-এর ফলে তিন ভাই ভিখিরি হয়ে গেল। আমার আর ছোট ভাই অমিতের জুটলো আঠারো লাখ করে। আমি আমার ভাগের টাকা দিয়ে দিলাম জলপাইগুড়ির এক অখ্যাত গ্রামের স্কুলে যেখানে আমার ঠাকুর্দা অভয়চরণ ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে সেভেনেই পড়াশুনা ছাড়তে বাধ্য হন।
খুব ভাল করেছেন।
শান্ত উঠে দাঁড়াতেই বিমলবাবু বলেন, তোকে আর একটু বসতে হবে।
শান্ত বসতেই উনি একটু হেসে বলেন, আমার আদি বাড়ি জলপাইগুড়ি শুনেই তোর মা একদিন বললেন, দিদিমার কাছে শুনেছি উনি অনেক বছর জলপাইগুড়ির একটা চা বাগানে ছিলেন।
দিদিমা ছিলেন মানে? ওর স্বামী কী চা বাগানে চাকরি করতেন?
না, না; দিদিমার স্বামী না, দিদিমার বাবা একটা নামকরা চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন।
উনি কোন বাগানের ম্যানেজার ছিলেন?
যতদূর মনে পড়ছে বোধহয় মডার্ন।
আপনার দিদিমার নাম কী?
পাঁপড়ি।
বিমলবাবু একগাল হেসে বলেন, এবার আমি বলি, আপনার দিদিমার বাবার নাম অপূর্ব আর মা-র নাম নন্দিতা।
মনিকা দেবী চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, আপনি তাদের নাম জানলেন কী করে?
বিমলবাবু আবার হাসতে হাসতে বলেন, আপনার দিদিমার বাবা রিটায়ার করার পর তো কল্যাণীর বাড়িতে থাকতেন।
কী আশ্চর্য! আপনি তো আমার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছেন।
উনি না থেমেই বলেন, সত্যি করে বলুন তো কী করে আপনি এসব জানলেন।
আমার ঠাকুর্দার ডায়েরী থেকে। অপূর্ব সেনগুপ্ত ছিলেন আমার ঠাকুর্দার জীবন দেবতা; ওরই কৃপায় ঠাকুর্দা চা বাগানের বিখ্যাত সাপ্লায়ার হয়ে প্রায় রাস্তার ভিখারী থেকে রাজা হয়েছিলেন। আপনার দিদিমাকে আমার ঠাকুর্দা বলতেন ‘দিদি আর ওকে ‘দাদা’ বললেন অভাবনীয় সুন্দরী পাঁপড়ি।
এই কথা বলেই বিমলবাবু হো হো করে হেসে ওঠেন।
মনিকা দেবী বলেন, কেন জানি না দিদিমা বিয়ে করেন বোধহয় চল্লিশ বছর বয়সে আর তার সাত-আট বছর পর আমার মায়ের জন্ম।
এসব আমি জানি না।
বিমলবাবু সঙ্গে সঙ্গেই একটু হেসে বলেন, মোটকথা অভয়চরণ পাঁপড়ির মধুর সম্পর্কের বৃত্ত বোধহয় সম্পূর্ণ করবে শান্ত আর মৌ।
.
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, ভাল কাকা, এ তো ড্রিম কাম ট্রু।
ওরে ট্রুথ ইজ স্ট্রেনজার দ্যান ফিকসন।
ঠিক বলেছেন।
.
০৬.
এম. এ পরীক্ষা শেষ হবার পর মৌ-এর মনে হল যেন মহাযুদ্ধের শেষ হল। কবে শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ, তা আজ আর ওর ঠিক মনে পড়ে না। তবে স্পষ্ট মনে পড়ছে, তারপরের আট দশ-বছরের যুদ্ধের কথা। বছরে দুতিনটে পরীক্ষা দিতে দিতে প্রায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলার পর মাধ্যমিক।
দু’বছর পর আবার পরীক্ষা। সব গুরুজনেরাই বলেন, ভবিষ্যত জীবনের রাজপথে হাঁটার আসল পাসপোর্ট এই পরীক্ষা।
অর্থাৎ?
এক মিনিট সময় নষ্ট করবে না; দিন-রাত শুধু পড়তে হবে।
দু-তিন মাস পরও বন্ধুদের সঙ্গে একটা সিনেমা দেখব না?
নৈব নৈব চ।
এই দু’বছর সব ভুলে যাও; এখন তোমার ধ্যান-জ্ঞান শুধু…
বুঝেছি, আর বলতে হবে না। তোমরা কেউ বুঝতে চাও না, সতের-আঠারো বছরের মেয়ের মন। তোমরা জানো না, আমাদের মনেপ্রাণে এখন রামধনু রঙের খেলা। ক’বছর আগে থেকেই শরীরে জোয়ার আসতে শুরু করেছে কিন্তু এখন যে জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর। বাথরুমে চান করার সময় নিজেই নিজেকে দেখে অবাক হই, মুগ্ধও হই; বাপরে বাপ, কত ঢেউ খেলছে এই শরীরে।
হঠাৎ যেন নিজেই নিজেকে ভালবাসতে শুরু করি।
কে আমাদের মনের খবর রাখে?
তোমরা কী জানো, আমি আর শ্রীতমা যখন স্কুলে যাই ঠিক সেই সময় তখন পার্কের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে দেবুদা আর ওর দু’তিনজন বন্ধু। ওরা শুধু হাঁ করে আমাদের দুজনকে দেখে না, ওরা দু’চোখ দিয়ে যেন আমাদের গিলে খেতে চায়। শুধু কী চাই? ওদের মধ্যে কে একজন দু’এক কলি প্রেমের গানও গেয়ে ওঠে।
আমি আর শ্রীতমা কনুই দিয়ে একটু খোঁচা মেরে মুখ টিপে হাসি।
শুধু ওদেরই বা দোষ দিই কী করে? পথেঘাটে কত বয়স্ক লোকও বিশ্রী হ্যাংলার মতো আমাদের দেখে। সত্যি বলছি, এই লোকগুলোকে দেখলেই আমাদের ঘেন্না করে।
যাকগে ওইসব। ওইসব নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তা করি না। আপাতত আমাদের চিন্তা জীবনের রাজপথে পৌঁছবার পাসপোর্ট জোগাড় করার। তাছাড়া অবসর পেলেই আমরা আমাদের নিয়েই চিন্তা করি, চিন্তা করি মনের মানুষের। সত্যি শান্তদাকে কাছে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠি।
তারপর?
তারপর কলেজে ঢুকেই হঠাৎ বসন্তের বাতাস আমাদের যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল। স্কুলের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে হঠাৎ একটু স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে মনে নতুন আনন্দের জোয়ার। ক্লাসের অন্য মেয়েরা অচেনা হলেও চেনা হল কয়েকদিনের মধ্যেই। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতেও দেরি হল না।
বিলিভ মী, তোকে দেখেই আমার ভাল লেগেছিল।
রিয়েলী?
আমি এক গাল হেসে বলি, ইয়েস রুচিরা, ইয়েস।
আমি না থেমেই বলি, আমাকে দেখে তোর কী মনে হয়েছিল?