না, স্যার, রবিবার খুব সকালে আর সন্ধের পর কিছু খদ্দের আসে। দিনে খুব কম খদ্দের আসে।
নন্দিতা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তাহলে চল আমাদের সঙ্গে, সন্ধের আগেই ফিরে আসবে।
গেটের বাইরে জিপ থামে। সেনগুপ্ত দম্পতির পর অভয়চরণ জিপ থেকে নেমে দেখে বিরাট বাংলোর সামনে সবুজ কার্পেটের মতো লন আর তার পাশে সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। দূর থেকে বাংলো দেখেই ও অবাক হয়।
একটু পিছন ফিরে নন্দিতা বলে, এস অভয়।
সেনগুপ্ত সাহেব আগেই প্রায় লাফাতে লাফাতে বাংলোয় ঢুকেই গলা চড়িয়ে বলে, মাদার দেখো কে এসেছে।
দ্বিধা সংকোচে অভয়চরণ ধীর পদক্ষেপে বাংলোর বারান্দায় পা দিতেই পরমা সুন্দরী অষ্টাদশীকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, নতুন মাকে দেখতে কি ভাল; দেখে মনে হয়, সব সময় হাসছেন কিন্তু তুমি তো অসাধারণ সুন্দরী।
পাঁপড়ি হাসতে হাসতে বলে, কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? এস ভিতরে এস।
হ্যাঁ, চল।
অভয়চরণ এগিয়ে আসতেই নন্দিতা বলেন, মুন্নী, তুই অভয়কে তোর ঘরে নিয়ে যা। তোরা গল্প কর। আমি একটু পরে আসছি।
পাঁপড়ি অভয়চরণকে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকেই বলে, যেখানে খুশি বসতে পারো।
অভয়চরণ একবার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে সামনের একটা চেয়ারে বসে।
পাঁপড়ি একটা মোড়া নিয়ে ওর সামনে বসেই বলে, তুমি কী জানো, বাবা তোমাকে খুব ভালবাসেন?
অভয়চরণ একটু হেসে বলে, স্যার সত্যিই আমাকে খুব স্নেহ করেন।
ভাল ভাল বই পড়তে তোমার খুব ভাল লাগে, তাই না?
হ্যাঁ।
তুমি বাংলা-ইংরাজি দু’রকম বই-ই পড়ো?
আমি শুধু বাংলা বই পড়ি। আট বছর আগে স্কুল ছাড়ার পর তো আর ইংরেজি পড়া হয়নি।
তাতে কী হয়েছে? একটু কষ্ট করে পড়লেই বুঝতে পারবে।
আমি আগে একটা ইংলিশ-বেঙ্গলী ডিক্সনারী কিনব। তারপরই ইংরেজি বই পড়া শুরু করব।
পাপড়ি সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে একটা মোটা বই এনে ওর হাতে দিয়ে বলে, এই নাও ডিক্সনারী। এবার তো ইংরেজি বই পড়বে?
তুমি ডিক্সনারী আমাকে দিলে কিন্তু তোমার তো অসুবিধে হবে
না, না আমার অসুবিধে হবে না। আমার আরো একটা ডিক্সনারী আছে।
অভয়চরণ একটু হেসে বলে, দিদি, তুমি আমার দারুন উপকার করলে। তোমাকে কি বলে কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানাব তা ভেবে পাচ্ছি না।
পাঁপড়ি হাসতে হাসতে বলে তুমি একটা গাগল! আমাকে মোটেও কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানাতে হবে না
দিদি, তুমি দেখতে যেমন অসম্ভব সুন্দর, তোমার মনও ঠিক সেইরকম সুন্দর। ভগবান নিশ্চয়ই তোমার ভাল করবেন।
পাঁপড়ি জোরেই হেসে ওঠে।
ঠিক সেই সময় মিঃ সেনগুপ্ত ওই ঘরে ঢুকেই বলেন, মাদার হাসছ কেন?
ইওর অভয় ইজ টু গুড এ বয়।
নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট।
.
‘পরশপাথর’-এর গল্প পড়েছে অভয়চরণ। এই পরশপাথরের ছোঁয়ায় সবকিছু সোনা হয়ে যায়। অভয়চরণের বাস্তব জীবনে এই কি অপূর্ব সেনগুপ্তই ওর পরশপাথর।
সেনগুপ্ত সাহেবের কৃপাতেই ওদের অফিসার্স ক্লাবে মদ ছাড়া অন্যান্য জিনিষ সাপ্লায়ের ঠিকা পায়। শুরু হল চা-কফি-চিনি-গুঁড়ো দুধ, সাত-আট রকমের বিস্কুট, ক’রকমের দামী সিগারেট-দেশলাই ছাড়া পাঁচ রকমের কোল্ড ড্রিঙ্ক।
তারপর?
বছর পাঁচেক পরই শুরু হল চা বাগানের সাপ্লাই।
তারপর?
চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই শুরু হল একটার পর একটা চা বাগানের সাপ্লাই।
.
অভয়চরণ অকৃতজ্ঞ না। তাই তো মিঃ সেনগুপ্ত রিটায়ার করার পর কল্যাণীর বাড়িতে চলে গেলেও নববর্ষ আর বিজয়ার পরদিনই অভয়চরণ তার ‘স্যার’ আর নতুন মাকে প্রণাম করতে কোনদিন ভোলে নি। না, কোনদিন ভোলেনি ওদের দু’জন আর পাঁপড়ি দিদির জন্মদিনে প্রণাম আর শুভেচ্ছা জানানো ছাড়াও নানা উপহার পাঠাতে।
.
ছোট দু’বোন বি.এ পাস করার পরই অভয়চরণ ওদের বিয়ে দিয়েছেন দুটি সুপাত্রের সঙ্গে। মায়ের পছন্দমতো মেয়েকে নিজেও বিয়ে করেছেন।
তারপর?
অভয়চরণ অর্থাভাবে লেখাপড়া করতে পারেন নি বলেই উনি পাঁচ ছেলেকেই উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেন কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন কী সার্থক হয় নাকি সার্থক হতে পারে?
সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করায় বাহান্ন বছরেই অভয়চরণ হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন; মাস তিনেক পর সুস্থ হলেও অনেকটাই কর্মশক্তি হারালেন। বড় ছেলে অমল বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র থাকায় সে তখন কলকাতায় হস্টেলে থেকে এম. এ পড়ছে কিন্তু পরের তিন ছেলে দু’তিন বারের চেষ্টায় মাধ্যমিকের গণ্ডী পার হলেও ওরা কেউই উচ্চমাধ্যমিক পাস করতে পারল না।
প্রথমে অজয় আর অমিত বাবার ব্যবসা দেখতে শুরু করল।
ব্যস, ওদের আর কে দেখে? শুরু হল দু’ভাইয়ের মদ্যপান; প্রথমে লুকিয়ে চুরিয়ে। তারপর অনেকটাই খোলাখুলি।
অভয়চরণের শরীর দিন দিনই ভেঙে পড়ছে। তাইতো তিনি পাঁচ ছেলেকে ব্যবসার অংশীদার করতে চাইলেন কিন্তু বড় ছেলে অমল স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, সে ব্যবসা বাণিজ্য বোঝে না। তাইতো অংশীদারও হতে চায় না। শেষ পর্যন্ত অন্য চার ছেলেকেই অভয়চরণ ব্যবসার সমান অংশীদার করে দিলেন।
অমল এম. এ. বি. টি পাস করে কাটোয়ার স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করার পর পরই অভয়চরণের মৃত্যু হয়। শ্রাদ্ধাদি শেষ হবার পর অমল তার মাকে কাটোয়ায় নিজের কাছে নিয়ে আসে।
ওদিকে অমলের সবচেয়ে ছোট ভাই অমিত ছাড়া অন্য তিন ভাই আগেই নিজেদের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেছে আর সারা জলপাইগুড়ি শহরে ছড়িয়ে গেছে ওদের বেলেল্লাপনার খবর।