হরেন কাকা একটু হেসে বলেন, এদের সবার পকেটেই টু-পাইস থাকে। এদের একটু খাতির করলে আখেরে তোরই ভাল হবে।
কাকা, আমি তো সব খদ্দেরকেই যথেষ্ট সম্মান করি।
ভালই করিস।
.
তারপর আস্তে আস্তে অভয়চরণের সঙ্গে খদ্দেরদের আলাপ পরিচয় হতে শুরু হয়।
বাবু, আপনি কী এই দিকের কোন চা বাগানে কাজ করেন?
কেন বল তো?
আপনি তো সপ্তাহের ছ’দিনই আমার এখানে চা খেয়ে ওই দিকে যান তাই…
বীরেনবাবু একটু হেসে বলেন, থার্ড ক্লাস মাড়োয়ারির ফোর্থ ক্লাস বাগানে গোলামী করি। হালারা আমাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে।
সব বাগানের মালিকরাই কী ওইরকম?
না, না।
বীরেনবাবু না থেমেই বলেন, সব দিক দিয়েই এই অঞ্চলের বেস্ট বাগান হচ্ছে মডার্ন।
সব দিক দিয়েই বেস্ট মানে?
এই অঞ্চলের সব বাগানের চাইতে ওদের চা সব চাইতে ভাল। ওখানকার প্রত্যেক কর্মচারী ন্যায্য মাইনে পায়, বোনাস পায়। তাছাড়া ওই বাগানের ম্যানেজার সাহেবকে তো সব কর্মচারীরা দেবতার মতো ভক্তি করে।
আচ্ছা!
হ্যাঁ, অভয়, উনি অসম্ভব ভাল মানুষ। উনি প্রতিদিন লেবার কোয়ার্টার্স থেকে শুরু করে হাসপাতালেও আসেন স্টাফ বা লেবারদের সুবিধে-অসুবিধের খোঁজখবর নিতে।
অন্য বাগানের ম্যানেজাররা তা করেন না?
ঘোড়ার ডিম করেন।
বীরেনবাবু একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, অন্য বাগানের ম্যানেজারদের প্রধান কাজ হচ্ছে ঘুষ খাওয়া, চুরি করা আর ফুর্তি করা।
.
অভয়চরণের কাছে চা খাবার জন্য অন্যান্য খদ্দেরদের মধ্যে ছ’জন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আসেন তিনটে মোটর সাইকেল চড়ে। ওদের দেখে মনে হয় ওরা ভাল চাকরি করেন। আস্তে আস্তে ওদের সঙ্গেও বেশ ভালই আলাপ-পরিচয় হয় অভয়চরণের; তাইতো জানতে পারে, ওরা ছ’জনই মডার্ন টি এস্টেটে কাজ করেন।
শুনছিলাম, এই অঞ্চলের মধ্যে আপনাদের বাগানের চা সব চাইতে ভাল। কথাটা কি ঠিক?
ছ’জনের মধ্যে যিনি বয়সে বড় তিনি বেশ জোর করে বলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
উনি না থেমেই বলেন, অন্য বাগানে একই গাছ থেকে পনের বিশ বছর পাতা নেওয়া হয় কিন্তু আমাদের বাগানে ক’বছর অন্তরই পুরনো গাছের জায়গায় নতুন গাছ লাগানো হয়। তাইতো আমাদের বাগানের চা এত ভাল।
ওদের যিনি বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘মডার্ন’ হচ্ছে আমাদের যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী।
অন্যরা প্রায় একসঙ্গে বলেন, ঠিক বলেছিস।
.
ছ’-আট মাস পরের কথা।
অভয়চরণের দোকানে হঠাৎ একটা বড় মোটর গাড়ি এসে থামতেই ড্রাইভার তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এসে বলে, তোমার নাম কী অভয়চরণ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গিয়ে পিছনে বসা সাহেবকে কি যেন বলে। তারপরই একজন অত্যন্ত সুদর্শন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এসে একটু হেসে বলেন, আমি মডার্ন টি এস্টেটের ম্যানেজার অপূর্ব সেনগুপ্ত।
অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে ওকে প্রণাম করেই বলে, স্যার আমার কি সৌভাগ্য।
আমাদের বাগানের অনেকেই তো তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের কাছেই শুনলাম, তুমি নিয়মিত ভাল ভাল বই পড়ো।
স্যার, ভাল ভাল বই পড়তে আমার খুব ভাল লাগে; তাই যখন খদ্দের থাকে না, তখন বই পড়ি।
এখন কোন বই পড়ছ?
স্যার, শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী পড়ছি।
খুব ভাল।
স্যার, দয়া করে একটু চা খাবেন?
দয়া করে বলছ কেন? এবার থেকে যাতায়াতের পথে সবসময় তোমার এখানে চা খাব।
অভয়চরণ একগাল হেসে বলে, স্যার, গাড়িতে বসুন আমি এখুনি চা দিচ্ছি।
গাড়িতে বসব কেন? তোমার বেঞ্চিতেই বসছি।
মিঃ সেনগুপ্ত বেঞ্চিতে বসেই বলেন, আমার ড্রাইভার মাখনকে চা দিও।
হ্যাঁ, স্যার দেব।
চা খাওয়া শেষ হতেই মিঃ সেনগুপ্ত পার্স বের করে বলেন কত হয়েছে? স্যার, আট আনা।
উনি একটা পাঁচ টাকার নোট এগিয়ে ধরে বলেন, এটা নাও এরপর কয়েকবার চা খেয়ে আর দাম দেব না।
অভয়চরণ হাসে।
আবার সন্ধের পর মিঃ সেনগুপ্তর গাড়ি এসে থামে ওই দোকানের সামনে।
মিঃ সেনগুপ্ত একটা মোটা বই এগিয়ে ধরে বলেন, এটা হচ্ছে চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বিদ্যাসাগরের জীবনী।
অভয়চরণ বই হাতে নিয়ে বলে, স্যার, কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব তা ভেবে পাচ্ছি না।
ধন্যবাদ দিতে হবে না; বইটা পড়ো।
নিশ্চয়ই পড়ব।
এবার আমাদের চা খাওয়াও তো।
হ্যাঁ, স্যার, দিচ্ছি।
এইভাবেই শুরু হল ওদের সম্পর্ক।
কয়েক মাস পরের কথা।
.
সেদিন রবিবার। হঠাৎ একটা জিপ এসে থামল অভয়চরণের দোকানের সামনে। ও ভেবেছিল, বোধহয় কোন কন্ট্রাক্টারের জিপ। তারপর সেনগুপ্ত সাহেবকে জিপ থেকে নামতে দেখেই ও অবাক। সঙ্গে সঙ্গে জিপ থেকে নামেন মিসেস সেনগুপ্ত।
মিঃ সেনগুপ্ত একটু হেসে বলেন, নন্দিতা এই হচ্ছে অভয়।
অভয়চরণ প্রথমে ওকে, তারপর সেনগুপ্ত সাহেবকে প্রণাম করে।
নন্দিতা ওর মাথায় হাত দিয়ে বলেন, ভাল থাকো বাবা।
উনি সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বলেন, তোমার এত প্রশংসা শুনতে হয় যে তোমাকে না দেখে থাকতে পারছিলাম না।
স্যার আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন।
সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
আগে বল, আমাদের ওখানে কবে আসবে?
আপনি আমার নতুন মা। আপনাদের কাছে যেতে খুব ইচ্ছা করে কিন্তু যেতে হলে তো দোকান বন্ধ রাখতে হবে।
মিঃ সেনগুপ্ত বলেন, অভয়, তোমার দোকানে কী রোজই সমান খদ্দের আসে? একই টাকার বিক্রি হয়?