উনি মালপত্র দিয়ে চলে যাবার আগে বলেন, আমি এক সপ্তাহের মধ্যে তোর দোকান বড় করে দিচ্ছি।
.
সত্যি জগদীশ মিস্ত্রি যে এক সপ্তাহের মধ্যে দোকানটাকে এত সুন্দর আর বড় করে দেবে, তা অভয়চরণ ভাবতে পারেনি।
তারপর হরেন সাপ্লায়ার ওকে বলেন, কীরে অভয়, দোকানঘর তোর পছন্দ হয়েছে?
কাকা, সত্যি বলছি এত ভাল হবে তা ভাবিনি।
অভয়চরণ না থেমেই বলে, উপরের খোপে আমি আমার বিছানাপত্র রাখব। দোকানের তাকগুলোতে সব জিনিষ সাজিয়ে রাখক আর নীচে রাখব এক্সট্রা স্টক আর এক পাশে রাখব রান্না-খাওয়ার বাসনপত্র।
এবার তো ভাল করে শুতে পারবি?
হ্যাঁ, কাকা, খুব ভালভাবে শুতে পারব।
অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে বলে, কাকা কত খরচ হল?
জগদীশ পুরো হিসেব দেয়নি। তবে বোধহয় সাড়ে তিন-চারের বেশি হবে না।
কাকা, আমাকে কীভাবে শোধ করতে হবে?
তুই প্রত্যেক সপ্তাহে আমাকে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা দিতে পারবি না?
অভয়চরণ একটু হেসে বলে, হ্যাঁ কাকা, তা পারব।
হরেন সাপ্লায়ার মালপত্র দিয়ে চলে যাবার আগে বলেন, আমি জগদীশকে বলেছি চারজন করে বসতে পারে এমন দুটো বেঞ্চি তোকে দিয়ে যেতে।
অভয়চরণ একগাল হেসে বলে, তাহলে তো খুব ভাল হয়।
.
তারপর?
তারপর আর কি? অভয়চরণের অদৃষ্টের চাকা বন বন করে ঘুরতে শুরু করল। কোনদিনই তিনশ সাড়ে তিনশ’র কম বিক্রি হয় না। সপ্তাহে দু’একদিন সাড়ে চারশ-পাঁচশ টাকার বিক্রি হয়।
দোকানে খদ্দের না থাকলেই অভয়চরণ কোন না কোন বই পড়ে। ও যখনই বাড়ি যায়, তখনই বাল্যবন্ধু শশাঙ্কর কাছ থেকে দু’একটা বই নিয়ে আসে। খদ্দের এলেই অভয়চরণ হাতের বই রেখে ওদের হুকুম মতো কাজ করে। কদাচিৎ কখনও কোন কোন খদ্দের ওকে জিজ্ঞেস করেন, দেখি কী পড়ছ।
অভয়চরণ তাকে হাতের বই তুলে দিতেই ভদ্রলোক একবার বইয়ের পাতা উল্টেই বলেন, তুমি ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদারের লেখা ‘ভারতের ইতিহাস’ পড়ছ?
হ্যাঁ।
বইটা পড়তে ভাল লাগছে?
হ্যাঁ, খুব ভাল লাগছে।
ভাল।
এইভাবেই কেটে যায় মাসের পর মাস, ঘুরে যায় বছর। এই এক বছরের মধ্যেই অভয়চরণ সংসারের চেহারা বদলে দেয়। দু’বোনকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দেয়। মা-বোনেদের মুখে হাসি দেখে অভয়চরণ মনে মনে বড় শান্তি পায়।
ওদিকে কিছু কিছু খদ্দেরের সঙ্গেও অভয়চরণের বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ছাতি বন্ধ করে দিনহাটা স্কুলের মাস্টারমশাই শশধরবাবুকে বেঞ্চিতে বসতে দেখেই অভয়চরণ ওকে প্রণাম করে বলে, স্যার, ভাল আছেন?
হ্যাঁ, ভাল আছি। তুমি ভাল আছ?
আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে ভালই আছি।
তোমার মা-বোনেরা ভাল…
হ্যাঁ, স্যার, ওরাও ভাল আছে।
বেশ।
স্যার, চা খাবেন তো?
হ্যাঁ, দাও। যতক্ষণ বাস না আসে। ততক্ষণ তো বসতেই হবে।
অভয়চরণ ওর হাতে চায়ের গেলাস তুলে দিয়েই বলে, স্যার আপনার মেয়ে-জামাই ভাল আছেন?
হ্যাঁ, ওরা ভালই আছে।
শশধরবাবু চায়ের গেলাসে এক চুমুক দিয়েই একটু হেসে বলেন, তবে আমার তিন বছরের নাতি কি ওস্তাদ হয়েছে, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
দাদুকে কাছে পেলে ও তো একটু বাঁদরামী করবেই।
কাল ওই বাঁদরটা বলছে, দাদু, তুমি বাবার মতো মোটর সাইকেল চালাতে পারো?
আপনি কী বললেন?
আমি বললাম, না। আমার খুব ভয় করে।
শশধরবাবু সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে বলেন, ওই বাদরটা আমাকে বলে, তুমি এক নম্বরের ভীতু।
অভয়চরণ একটু জোরেই হেসে ওঠে।
.
তিস্তা তোর্ষার জল আরো গড়িয়ে যায়।
গাড়িটা দোকানের সামনে থামতেই অভয়চরণ দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। মিঃ সেনগুপ্ত গাড়ি থেকে নামতেই অভয়চরণ ওকে প্রণাম করে।
মিঃ সেনগুপ্ত হাসতে হাসতে বলেন, দেখা হলেই কী প্রণাম করতে হবে?
আপনি গুরুজন। আবার আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। তাছাড়া আপনি আমাকে স্নেহ করেন। আপনাকে প্রণাম করলে আমারই ভাল হবে।
অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে বলে, স্যার নতুন মা ভাল আছেন?
হ্যাঁ, নন্দিতা ভাল আছে?
স্যার, দিদির কী খবর?
তুমি তো জানো, ওকে আমি হস্টেলে রেখেছি। আমাদের চা বাগান থেকে শিলিগুড়িতে যাতায়াত করলে তো ও পড়াশুনারই সময় পাবে না।
তা ঠিক।
তবে পাপড়ি তো প্রত্যেক মাসেই দু’একদিনের জন্য আসে।
দিদি যখনই যাতায়াত করে তখনই আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব না করে যায় না।
হ্যাঁ, ও তোমাকে খুবই পছন্দ করে।
অভয়চরণ মিঃ সেনগুপ্তর হাতে চায়ের গেলাস তুলে দিয়েই একটু হেসে বলে, স্যার, দিদির নাম পাপড়ি দিয়ে খুব ভাল করেছেন, দিদি সত্যি ফুলের মতো পবিত্র।
ওর কথা শুনে মিঃ সেনগুপ্ত না হেসে পারেন না।
অভয়চরণ ড্রাইভার হৃদয়কে চা দিয়ে বলে, দাদা, চা খাও।
তোমার এখানে চা না খেয়ে স্যারও যেতে পারেন না, আমিও যেতে পারি না।
সে তো আমার সৌভাগ্য।
চা খাওয়া শেষ করেই মিঃ সেনগুপ্ত ড্রাইভারকে বলেন, হৃদয় বইয়ের প্যাকেটটা অভয়কে দিয়েছ?
স্যার, চা খেয়ে দিচ্ছি।
চা খেয়ে হৃদয় বইয়ের প্যাকেটটা অভয়চরণের হাতে দিতেই মিঃ সেনগুপ্ত বলেন, এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ আছে, তোমার নিশ্চয়ই ভাল লাগবে।
উনি না থেমেই বলেন, অভয় মনে রেখো রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প লেখক।
অভয়চরণ ওকে প্রণাম করতেই মিঃ সেনগুপ্ত গাড়িতে উঠতে উঠতে বলেন, আজ আসি।
অভয়চরণ শুধু মাথা নাড়ে আর অবাক হয়ে ভাবে ওর কথা।
.
এই অঞ্চলের সমস্ত চা বাগানের মধ্যে সব চাইতে বড় ও বিখ্যাত হচ্ছে মডার্ন টি এস্টেট। অভয়চরণ আগে এর নামও শোনে নি; হরেন কাকার কাছে শুধু শুনেছিল, এই রাস্তা দিয়েই যারা মোপেড, স্কুটার, মোটর সাইকেলে যাতায়াত করে তারা প্রায় সবাই হয় কোন না কোন চা বাগানে কাজ করে অথবা ব্যবসা করে।