এবার মেমসাহেব তাড়া দেয়, নাও, চটপট তৈরী হয়ে নাও। আমি শুয়ে শুয়েই বললাম, ওয়াড্রবটা খোল। আমাকে একটা প্যাণ্ট আর বুশশার্ট দাও।
মেমসাহেব লম্বা বেণী দুলিয়ে বেশ হেলেন্দুলে এগিয়ে গিয়ে ওয়াড়ব খুলেই প্ৰায় চীৎকার করে উঠল, একি তোমার ওয়াড্রবে শাড়ি।
একবার শাড়িগুলো নেড়ে বলল, এ যে অনেক রকমের শাড়ি। ঘুরে ঘুরে কালেকশন করেছ বুঝি?
ও আমার প্যাণ্ট-বুশ-শার্ট না দিয়ে হাঙ্গার থেকে একটা কটুকি শাড়ি এনে আমার কাছে আব্দার করল, আমি এই শাড়িটা পরব?
তবে কি আমি পরব?
শাড়িটার দু-একটা ভাজ খুলে একটু জড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, লাভলি!
কি লাভলি? শাড়ি না আমি?
শাড়িটা গায়ে জড়িয়েই আয়নার সামনে একটু ঘুরে গোল মেমসাহেব। বলল, ইউ আর নটেরিয়াস বাট শাড়ি ইজ লাভলি। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে মেমসাহেবকে জড়িয়ে ধরতেই ও বকে উঠল, সব সময় জড়াবে না। শাড়িটার ভাঁজ নষ্ট করো না।
চট করে ও এবার আমার দিকে ঘুরে আমার মুখের দিকে ব্যাকুল হয়ে চেয়ে বলল, ওগো ব্লাউজের কি হবে? তুমি নিশ্চয়ই ব্লাউজ পিস কেননি?
আমি ওর কানটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঘরের কোণায় নিয়ে গিয়ে একটা ছোট সুটকেস খুলে দিলাম। নটি গার্ল! হ্যাভ এ লুক।
হাসতে হাসতে বলল, ব্লাউজ তৈরী করিয়েছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
মাপ পেলে কোথায়?
তোমার ব্লাউজের মাপ আমি জানি না?
আমার মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি আসে। কানে কানে বলি, সুড আই টল ইউ ইউর ভাইট্যাল স্ট্যাটিকটিস?
মেমসাহেব আমার পাশ থেকে পালিয়ে যেতে যেতে বলল, কেবল অসত্যতা। জার্নালিস্টগুলো বড় অসভ্য হয়, তাই না?
তোমাদের মত ইয়ং আনম্যারেড প্রফেসারগুলো বড় ধার্মিক হয়, তাই না?
কি করব? তোমাদের মত এক-একটা দস্যু-ডাকাতের হাতে পড়লে আমাদের কি নিস্তার আছে?
আমি যেন আরো কি বলতে গিয়েছিলাম, ও বাধা দিয়ে বলল, এবার তর্ক বন্ধ করে বেরুবে কি?
মেমসাহেব শাড়িটা সোফার পর রেখে নিজের সুটকেস থেকে ধুতি-পাঞ্জাবি বের করে বলল, এই নাও পর।
এবারও জড়িপাড় ধুতি দিলে না? জড়িপাড় ধুতি না পাবার জন্য তোমার কি কিছু অসুবিধা বা ক্ষতি হচ্ছে?
দোলাবৌদি, আমার জীবনের সেসব স্মরণীয় দিনের কথা স্মৃতিতে অমর অক্ষয় হয়ে আছে। আজ আমি রিক্ত, নিঃস্ব। ভিখারী। আজ আমার বুকের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে অহরহ রাবণের চিতা জ্বলিছে। গঙ্গা-যমুনা নর্মদা-গোদাবরীর সমস্ত জল দিয়েও এ আগুন নিভবে না, নেভাতে পারে না।
বাইরে থেকে আমার চাকচিক্য দেখে, আমার পার্থিব সাফল্য দেখে, আমার মুখের হাসি দেখে সবাই আমাকে কত সুখী ভাবে। কত মানুষ আরো কত কি ভাবে। আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কতজনের কত বিচিত্র ধারণা! মনে মনে আমার হাসি পায়। একবার যদি চিৎকার করে কাঁদতে পারতাম, যদি তারস্বরে চিৎকার করে সব কিছু বলতে পারতাম, যদি হনুমানের মত বুক চিরে আমার অন্তরটা সবাইকে দেখাতে পারতাম। তবে হয়ত–
দেখেছ, আবার কি আজে-বাজে বকতে শুরু করেছি? তোমাকে তো আগেই লিখেছি ঐ পোড়া কপালীর কথা লিখতে গেলে, ভাবতে গেলে, মাঝে মাঝেই আমার মাথাটা কেমন করে। উঠে। আরো একটু ধৈৰ্য ধরা। তুমি হয়ত বুঝবে আমার মনের অবস্থা।
দোলাবৌদি আমাদের দুজনের কাহিনী নিয়ে ভলিউম ভলিউম বই লেখা যায়। সেই সাত দিনের দিল্লী বাসের কাহিনী নিয়েই হয়ত একটা চমৎকার উপন্যাস লেখা হতে পারে। তাছাড়া তিন দিনের জন্য জয়পুর আর সিলিসের ঘোরা? আহাহা! সেই তিনটি দিন যদি তিনটি বছর হতো। যদি সেই তিনটি দিন কোন দিনই ফুরাত না।
দিল্লীতে সেই প্ৰথম রাত্ৰিতে আমরা এক মিনিটের জন্যও ঘুমুলাম না। সারা রাত্ৰি কথা বলেও ভোরবেলায় মনে হয়েছিল যেন কিছুই বলা হলো না? মনে হয়েছিল যেন বিধাতাপুরুষের রসিকতায় রাত্রিটা হঠাৎ ছোট হয়েছিল। সকালবেলায় সূৰ্যকে অসহ্য মনে হয়েছিল।
মোটা পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মি চুরি করে আমাদের ঘরে ঢুকে বেশ উৎপাত শুরু করেছিল। কিন্তু তবুও ও আমার গলা জড়িয়ে শুয়ে ছিল আর গুনগুন করে গাইছিল, আমার পরাণ যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো…
আমি প্রশ্ন করলাম, সত্যি? ও বলল, তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো। তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও–
আমি আবার কোথায় যাব?
মেমসাহেব মাথা নেড়ে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার গাইতে থাকে, আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো।
সিওর?
সিওর।
ও এবার কনুই-এর ভর দিয়ে ডান হাতে মাথাটা রেখে বাঁ হাত দিয়ে আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গাইল–
আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস–
দীর্ঘ দিসব, দীর্ঘ রজনী,
দীর্ঘ বরষ-মাস।
যদি আর-কারে ভালবাস…
আমি বললাম, তুমি পারমিশন দেবে?
মেমসাহেব হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই আবার গাইল–
আর যদি ফিরে নাহি আস,।
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও,।
আমি যত দুঃখ পাই গো।
আমি বললাম, আমি আর কিছু চাইছি না, তুমিও দুঃখ পাবে না।
ও আমাকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে চেপে ধরে ঠোঁটে একটু ভালবাসা দিয়ে বলল, আমি তা জানি গো, জানি।
সকালবেলায় চা খেতে খেতে মেমসাহেব বলল, ওগো, চলে না। দুদিনের জন্য জয়পুর ঘুরে আসি।
আইডিয়াটা মন্দ লাগল না। ঐ চা খেতে খেতেই প্ল্যান হয়ে গেল। একদিন জয়পুর, একদিন সিলিসের ফরেস্ট বাংলোয় থাকব। তারপর দিল্লী ফিরে এসে কিছু ঘোরাঘুরি, দেখাশুনা আর সংসার পাতার বিধিব্যবস্থা করা হবে বলেও ঠিক করলাম।
১৫. আমাকে কিছু করতে হলো না
আমাকে কিছু করতে হলো না, মেমসাহেব আমার একটা অ্যাটাচির মধ্যে দুদিনের প্রয়োজনীয় সব কিছু ভরে নিয়েছিল। আমি দু’একবার এটা ওটা নেবার কথা বলেছিলাম। ও বলেছিল, তুমি চুপ করে তো।