চাদর সরিয়ে মুখ বের করতেই সুভাষদা বললেন, ভয় নেই, কোনো পাওনাদার না, আমি তোমার সুভাষদা।
সুভাষদা!
আমি ভূত দেখার মতো চমকে লাফিয়ে উঠলাম। সুভাষদা, আপনি?
এখনও কি তোমার সন্দেহ হচ্ছে?
না কিন্তু আপনি কবে এলেন? বৌদি কোথায়? রমার কি খবর? এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললাম।
সুভাষদা হাসতে হাসতে বললেন, সবাই এসেছে। তুমি চোখে মুখে জল দিয়ে এসো, তারপর সব বলছি।
আমি বিছানায় উঠে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, কই ওরা কোথায়? বৌদি আর রমা কি গাড়িতে…।
ওরা এখন আমার সঙ্গে আসেনি; তবে দিল্লিতেই আছে।
ওদের নিয়ে এলেন না কেন?
বলছি তো চোখে-মুখে জল দিয়ে এসো, তারপর সব জানতে পারবে।
আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে রাধাকিষণকে ডেকে বললাম, পর্দা হঠাও আর চা বানাও।
তাড়াতাড়ি চোখে মুখে জল দিয়ে ফিরে আসতেই সুভাষদা বললেন, কত কাণ্ড করে যে তোমার এখানে এসেছি তা ভাবতে পারবে না।
কেন, আপনি আমার বাড়ির ঠিকানা জানতেন না?
সুভাষদা হাসতে হাসতে বললেন, তোমার মতো নটোরিয়াস ব্যাচেলার কখনও বাড়ির ঠিকানা জানায়?
লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, খুব ঘুরতে হয়েছে বুঝি?
টেলিফোন এনকোয়ারি থেকে ভুল ঠিকানা জানাল। তাছাড়া দিল্লি এত বদলে গেছে যে নতুন এসে তালগোল পাকিয়ে যায়।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, দেখে-শুনে মনে হয় এরা বোধহয় দিল্লিকে প্যারিস বানাতে চায়।
গৌরী সেনের টাকায় নিত্যনতুন স্কীম হচ্ছে আর মাসে-মাসে শহরের চেহারা বদলে যাচ্ছে।
কিন্তু তার ঠেলায় তো আমাদের মতো নিউকামারদের জান বেরিয়ে যায়।
আই অ্যাম সরি। যাই হোক আর চিন্তা নেই। এবার বলুন কবে এলেন, কোথায় উঠেছেন?
রাধাকিষণ চা-বিস্কুট দিয়ে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সুভাষদা বললেন, রাগ করো না, ঠিক একমাস হলো এসেছি…।
আমি অবাক হই, একমাস?
একমাস এসেছি ঠিকই কিন্তু নতুন করে সংসার পাতার যা ঝামেলা, সে আর বলার না। তাছাড়া অফিসেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকি অথচ তোমার বৌদি তোমাকে খুঁজে বের করার জন্য পাগল করে ছাড়ছেন…
হাসলাম। তারপর?
রোজই ভাবি আমাদের কোনো পি আর ওকে তোমার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করব কিন্তু রোজই ভুলে যাই। আজ সকালে তোমার বৌদি এমন বকবক করতে শুরু করলেন যে না বেরিয়ে পারলাম না।
আমি শুকনো হাসি হেসে বললাম, আপনি যাই কৈফিয়ত দিন আমি স্যাটিসফায়েড হচ্ছি না।
সত্যি বিশ্বাস কর ভাই, এবার দিল্লিতে এসে যা হয়রানি সহ্য করেছি, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
সে তো বুঝলাম, কিন্তু এসেই কেন আমার খোঁজ করলেন না?
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে সুভাষদা বললেন, আই জাস্ট গট লস্ট ইন প্রবলেমস।
সুভাষদার স্ত্রী, মিসেস জয়তী রায়, আমার বৌদি সত্যি আমাকে ভালোবাসেন। ডক্টর রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে আমেরিকা গিয়ে ওঁদের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। আমাদের অ্যাম্বাসীর ডিপ্লোম্যাট অন্যান্য স্টাফ ও তাদের ফ্যামিলী মেম্বারদের ইনফরম্যাল গেট-টুগেদার এ বৌদিকে দেখেই ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ জিজ্ঞাসা করলেন, হাউ আর ইউ জয়ন্তী?
বৌদি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ডক্টর রাধাকৃষ্ণণকে প্রণাম করে বললেন, ভালো আছি স্যার।
শুধু ফ্যাশান শো অর্গানাইজ করছ না কি কিছু লেখাপড়াও করছ?
সামান্য কিছু লেখাপড়াও করছি স্যার।
গুড। ভেরি গুড। এবার আমার দিকে ফিরে ডক্টর রাধাকৃষ্ণন বললেন, ডু ইউ নো, জয়ন্তী আমার কিছু কিছু লেখা বাংলায় অনুবাদ করেছে অ্যান্ড আই অ্যাম টোন্ড দে আর ভেরি গুড।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তাই নাকি?
.
আমি একটু মুগ্ধ দৃষ্টিতে বৌদির দিকে তাকালাম, বৌদিও আমাকে দেখলেন। পরে মাঝে মাঝেই বৌদি মজা করে হাসতে হাসতে সুভাষদাকে বলতেন, তোমার জার্নালিস্ট সেদিন যে কি রোমান্টিক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল তা তুমি ভাবতে পারবে না।
সুভাষদা আমার দিকে তাকিয়ে একটু ইশারা করেই বৌদিকে বললেন, তোমারও নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল।
তুমি তো জীবনেও কোনোদিন অমন করে তাকাওনি, সুতরাং ভালো না লাগার তো কারণ নেই।
এবার সুভাষদা স্ত্রীকে খুশী করার জন্য বললেন, তাছাড়া জার্নালিস্টের রোমান্টিক হবার কারণ ছিল। তোমাকে দেখে তো বোঝা যায় না তোমার কত বয়স! নো ডাউট ইউ আর স্টিল ভেরী চার্মিং।
সুভাষদা স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ঠাট্টা করলেও কথাটা ঠিক। জয়ন্তী বৌদি সত্যি সুন্দরী! পরিপূর্ণ নারীত্বের সৌন্দর্য ছাড়াও চোখে-মুখে বুদ্ধিদীপ্তির ছাপ বৌদিকে আরো সুন্দরী করেছিল। রমার মধ্যে এটা আরো বেশি স্পষ্টভাবে চোখে পড়ত।
বহু মেয়ের দৈহিক সৌন্দর্য থাকে। বিদ্যাবুদ্ধিরও একটা নিজস্ব লাবণ্য আছে। রমার মধ্যে এই সৌন্দর্য আর লাবণ্যের মিলনে একটা অদ্ভুত শ্রী সবার দৃষ্টি টেনে নিত।
বৌদির অনুরোধ রক্ষা করতে কলকাতা যাবার পথে বেনারস গেছি রমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি আগে থেকে ওকে চিঠি দিয়েছিলাম আমার আসার সব কিছু খবর জানিয়ে। ওদের হোস্টেলের কাছাকাছি এসে দোতলার বারান্দায কয়েকটি মেয়েকে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিটা নামিয়ে নিলাম। ঠিকই কিন্তু ঐ সামান্য কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই একটা শ্ৰীমণ্ডিত মুখের চেহারা আমার মনের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। মিনিট খানেকের মধ্যেই ঐ মেয়েটিই আমার সামনে এসে হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হোস্টেল খুঁজতে বেশি কষ্ট হয়নি তো?