বেশিক্ষণ ছিলাম না। ঘণ্টা খানেক বা ঘণ্টা দেড়েক। একজন মানুষকে চেনার পক্ষে সময়টা কিছুই নয়। তবু বড় ভালো লেগেছিল দেবব্রতর দাদাকে। এত বড় বৈজ্ঞানিক হয়েও বড় সহজ, সরল অমায়িক ব্যবহার। বিয়ে করেননি। নিশ্চয়ই করবেন না। বিয়ে করার কোনো বয়স নেই ঠিকই কিন্তু মন তো চাই। আনন্দের জন্য, উপভোগের জন্য, সম্ভোগের জন্য ডক্টর চৌধুরীর বিয়ে করার দরকার। নেই। ল্যাবরেটরি, মিটিং, সেমিনার করে যেটুকু সময় হাতে থাকে সেটুকু সময় পরিপূর্ণভাবে উনি উপভোগ করেন। সকালবেলা বেরুবার সময় রেডিওগ্রামে কয়েকটা রেকর্ড চাপিয়ে চলে যান। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেই সুইচ টিপে দেন। ঘর ভর্তি বাংলা বই। গল্প, উপন্যাস, কবিতার বই। দিল্লিতে কারুর বাড়িতে এত বাংলা বই দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একটু অবাক হয়ে একবার বললাম, আপনার তো বাংলা বইয়ের দারুণ কালেকশন।
ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, বাড়িতে বাংলা বই আর গানের রেকর্ড না থাকলে দেবুর স্ত্রী সারাদিন কাটাবে কি ভাবে?
আমি হাসলাম।
উনিও হাসলেন। এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে বললেন, সুভাষ মুখার্জির একটা কবিতায় পড়েছিলাম–বিংশ শতাব্দীতে।
মানুষের শোকের আয়ু
বড় জোর এক বছর।
উনি চুপ করে রইলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হঠাৎ ঐ কবিতাটা মনে হলো কেন?
কথাটা নির্মম হলেও বড় সত্যি। এ যুগের কোনো শোকের আয়ুই এক বছরের বেশি নয়। আমি মরে গেলেও হয়তো দেবু বা বৌমা এক বছর পর আমাকেও ভুলে যাবে কিন্তু এই বইগুলো, এই সব পেন্টিং বা গানের রেকর্ড শুনতে শুনতে নিশ্চয়ই আমার কথা ওদের মনে পড়বে।
মুগ্ধ হয়ে, বিস্মিত হয়ে আমি ওর কথা শুনছিলাম।
বিদায় নেবার আগে ডক্টর চৌধুরী বললেন, এরপর যেদিন আসবেন সেদিন আপনাকে আমার তোলা ফিল্মের প্রজেকশন দেখাব।
আপনি বুঝি ছবিও তোলেন?
তুলবো না? জ্যেঠু বড় না হলে তো বই পড়বে না বা গান শুনবে না। তাই তো ওর জন্য ছবি তুলে রাখছি।
.
এ সব পনের বছর আগেকার কথা। কত কি ঘটে গেছে এই দীর্ঘ পরিসরে। দ্বিতীয় বার বিলেত গেলাম তখন দেবব্রতর ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। রিজেন্ট পার্ক লেকের ধারে বসে দুজনে গল্প করেছি, ডুরি লেন থিয়েটারে মাই ফেয়ার লেডির অভিনয় দেখেছি। আরো কত কি। দুদিনের জন্য এসেক্সের সমুদ্র সৈকত ঘুরে এলাম। ঐ দুদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত সমুদ্র পাড়ে বসে দুজনে গল্প করেছিলাম।
আমি দিল্লি ফিরে আসার কয়েক দিন পরেই দেবব্রত চিঠিতে জানলাম ভালোভাবে পাস করেছে। দুতিন সপ্তাহ পরে দিল্লি ফিরেই আমাকে টেলিফোন করেছিল কিন্তু পায়নি। আমি ছুটিতে কলকাতা গিয়েছিলাম। ছুটির শেষে দিল্লি ফিরে এলাম। মাস খানেক কেটে গেল। হঠাৎ একদিন পুরনো চিঠিপত্তর ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দেবব্রতর একটা চিঠি হাতে পড়তেই ডক্টর চৌধুরীকে একবার টেলিফোন করলাম, দেবু ফিরছে কবে?
ও তো অনেক দিন হলো ফিরেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
ও কি এখানেই আছে?
ও তো চাকরি নিয়ে বাঙ্গালোরে চলে গেছে।
আমি একটু অবাক হলাম, দুঃখিত হলাম। আমার সঙ্গে একবার দেখা না করেই চলে গেল।
ডক্টর চৌধুরীও অবাক হলেন, সেকি? ও তো আপনার ওখানে কয়েক দিন গিয়েছে, দেখা হয়নি?
না। তাহলে বোধহয় আমি তখন কলকাতায় ছিলাম।
তাই হবে।
দেবব্রত হারিয়ে গেল। চিঠি লেখার অভ্যাস আমার নেই। বোধহয় ওরও তাই। তাছাড়া এমন। বিশ্রী অর্থহীন উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কেটে যায় যে বহু পরিচিত, ঘনিষ্ঠ মানুষের কথাও মনে পড়ে না। হঠাৎ মাঝে মাঝে খবরের পাতায় পড়ে বা রেডিওতে ডক্টর চৌধুরীর নাম শুনলেই লন্ডনের সেই ছাত্রসভার ছেলেটির কথাও মনে পড়ে। ভাবি চিঠি লিখব কিন্তু লিখি না। পরের দিনের উত্তেজনায় সে ইচ্ছা হারিয়ে যায়। তলিয়ে যায়।
ডক্টর চৌধুরীর সঙ্গেও আর যোগাযোগ নেই। কারণ আছে। উনি আর এখন ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির অন্ধকার গবেষণাগারের মধ্যে বন্দী নন। উনি এখন ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের সদস্য ছাড়াও প্ল্যানিং কমিশনের উপদেষ্টা। প্রায় ভি আই পি। খবরের কাগজের পাতায় প্রায় নিত্যই নাম ছাপা হচ্ছে। আজ শিলং, কাল সিমলা। দুদিন পরেই হায়দ্রাবাদ। পরের দিনই মাদ্রাজ হয়ে সিঙ্গাপুর। কলম্বো প্ল্যানের কনসালটেটিভ কমিটি মিটিং। কদাচিৎ কখনও বিজ্ঞান ভবনের কমিটি রুমে বা লবীতে দেখা হয়। আমাকে উনি চিনতে পারেন। জিজ্ঞাসা করেন, ভালো আছেন? আমি ছোট্ট জবাব দিই, হ্যাঁ। ওঁর কুশল জিজ্ঞাসা করার অবকাশ আমার হয় না, তার আগেই উনি কোনো মন্ত্রী বা আই-সিএস সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যান। ডক্টর চৌধুরীর এই উন্নতির জন্য দেবব্রতর অহঙ্কার হয়েছে কিনা জানতে পারি না। কিন্তু মনে মনে আশঙ্কা হয়, ভয় হয়। মাঝে মাঝে ওকে চিঠি লেখার ইচ্ছা হলেও ঠিক উৎসাহবোধ করিনা। পিছিয়ে যাই। কাগজ কলম নিয়ে বসেও লিখতে পারি না।
দুটি বছরে আরো কত কি ঘটে গেল। আরো কত মানুষকে জানলাম, চিনলাম, ভালোবাসলাম, কত মানুষকে ভুলে গেলাম দূরে সরিয়ে রাখলাম।
.
বেশ মনে আছে তার আগের দিন পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশন শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি দীর্ঘ ভাষণ নিয়ে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মে মাসের বিশে পর্যন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্যা নিয়ে সাড়ে সাত শ এম পির মতামত শুনে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সকালে ওঠার তাড়া নেই। রাধাকিষণকে বলেছি, চা নিয়ে ডাকাডাকি করিস না। অনেক বেলা অবধি ঘুমুব বলে টেলিফোনের প্লাগ খুলে রেখেছি। তাছাড়া রবিবার। নটা বেজে গেলেও আমি ঘুমুচ্ছিলাম। মোটা পর্দার ব্যুহ ভেদ করে সূর্যরশ্মি পর্যন্ত আমার শোবার ঘরে ঢুকতে পারেনি কিন্তু সুভাষ রায় এসে হাজির। ঘরে ঢুকেই চিৎকার, গেট আপ জার্নালিস্ট! গেট আপ