লাইব্রেরিয়ান ফ্রেমের মোটা চশমাটা ঠিক করতে করতে প্রফেসর প্রসাদ বললেন, ডোন্ট থিংক সো তবে বর্ডার এরিয়া কিছু স্পেশ্যাল ট্রিটমেন্ট পাবে বলে মনে হয়।
আমাদের দেশের যা অর্থনৈতিক অবস্থা তাতে এগ্রিকালচার, হেভী ইন্ডাস্ট্রি ও ডিফেন্স–এই তিনটি ক্ষেত্রেই কি সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব?
ডাঃ দত্ত বললেন, কোনোটাকে নেগলেক্ট করতে চান? কোনোটাকেই নেগলেক্ট করা যাবে না এবং হবে না।
পরের দিন সকালে সব খবরের কাগজে সে সংবাদ ফলাও করে ছাপা হয়। এই রকম একটা মিটিং-এর পরই ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীকে আমি প্রথম দেখি।
আমার বেশ মনে আছে সেদিনের কথা। আমন্ত্রিত সব বৈজ্ঞানিকই স্যুট পরে এসেছিলেন। ডক্টর চৌধুরী এসেছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে। দেখে ভারি ভালো লেগেছিল। তাছাড়া চেহারাটি মনে রাখার মতো। হঠাৎ দেখলে মনে হয় সাহিত্য বা দর্শনের অধ্যাপক। মনেই হয় না ইনি ল্যাবরেটরিতে বসে সূর্যরশ্মি নিয়ে গবেষণা করে যশস্বী হয়েছেন।
.
দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, দাদার সঙ্গে আপনার আলাপ আছে?
না, আলাপ নেই। তবে দেখেছি, দু-একবার সামান্য দুচারটে কথাও বলেছি।
এবার দিল্লি ফিরে দাদার সঙ্গে দেখা করবেন।
নিশ্চয়ই দেখা করব।
দাদা খুব খুশী হবেন। দেবব্রত একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো, অমন মানুষের সঙ্গে আলাপ করে আপনারও ভালো লাগবে।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কিন্তু ওর সঙ্গে তো আমি বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না।
কেন?
অত বড় পণ্ডিত মানুষের সঙ্গে কি বেশিক্ষণ কথা বলা যায়?
দেবব্রত হাসল, এখন কিছু বলব না, আলাপ করে আমাকে চিঠি দেবেন।
তিন সপ্তাহ পরে দিল্লি ফিরেই টেলিফোন করলাম। পেলাম না, পুণা গিয়েছিলেন। কয়েকদিন পরে আবার টেলিফোন করতেই ডক্টর চৌধুরী নিজে টেলিফোন ধরলেন। পরিচয় দিতেই বললেন, দেবুর চিঠিতে আপনার কথা জানলাম। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ওর শরীর ভালো আছে তো?
ভালোই আছে।
আপনি কদিন ওকে খুব খাইয়েছেন।
আমি না হেসে পারলাম না, সে কথাও লিখেছে?
ডক্টর চৌধুরীও হাসলেন, ও একটু পেটুক আছে। তাছাড়া আমাকে ও সব কথাই জানায়।
আমি যেদিন ডক্টর চৌধুরীর বাড়ি প্রথম গেলাম সেদিন রবিবার। দরজার সামনে দাঁড়াতেই গান শুনতে পেলাম। শিল্পীর কণ্ঠস্বর চিনতে না পারলেও সুর শুনে বুঝলাম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড। মিনিট খানেক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর বেল বাজালাম। প্রথমে চাকর, তারপর স্বয়ং ডক্টর চৌধুরী। আসুন আসুন।
ছোট্ট লবী পার হয়ে লিভিংরুমে ঢুকতে ঢুকতে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, অনেকবার বেল বাজিয়েছেন?
না, না, একবারই বাজিয়েছি।
দেন ইউ আর রিয়েলি লাকি।
কেন বলুন তো?
হঠাৎ একটু প্রাণ খুলে হাসলেন ডক্টর চৌধুরী। যখন তখন এমন গান শুনতে মেতে যাই যে কেউ বেল বাজালেও শুনতে পাই না। অবশ্য চাকরটাকে বার বার বলে রেখেছিলাম।
লিভিংরুমে ঢুকতেই অবাক হলাম, বাঃ! চমৎকার! পর পর অতগুলো কাংড়া ভ্যালী পেন্টিং দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।
ডু ইউ লাইক পেন্টিং?
কিছু বুঝি না কিন্তু দেখতে ভালো লাগে।
কাম টু মাই স্টাডি।
ডক্টর চৌধুরীকে অনুসরণ করে ওঁর পড়ার ঘরে ঢুকতেই সারা দেওয়াল ভর্তি স্কেচ দেখতে পেলাম।
আমার পোর্ট্রেটটা দেখেছেন?
বাঃ! ভারি সুন্দর!
ডু ইউ নো হু ইজ দ্য আর্টিস্ট?
আপনি নিশ্চয়ই!
না, না, আমার এত গুণ নেই…
কোনো ছাত্রের বুঝি?
না, দেবু।
মাই গড! পোর্ট্রেটটা ওর করা?
অব কোর্স। এ ঘরের সব স্কেচ আর পোর্ট্রেটই ওর করা। মুহূর্তের জন্য নিজের পোর্ট্রেটটা দেখে ডক্টর চৌধুরী একটু চাপা গলায় গর্বের সঙ্গে বললেন, দেবু রিয়েলি একটা জুয়েল।
পনের বছর আগের কথা। সব কথা মনে না থাকাই স্বাভাবিক কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, ডক্টর চৌধুরীর প্রতিটি কথায় ছোট ভাই সম্পর্কে তার গভীর ভালোবাসা ও দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল। ওঁর একটা কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না–দেবু ইজ এ পীস অব ড্রিম, দেবু আমার একটা স্বপ্ন, সাধনা। আমি অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে চাইতেই উনি বললেন, রিসার্চ করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেও আমার দুঃখ নেই। আজ না হয় কাল, কাল না পরশু কেউ না কেউ নিশ্চয়ই সাকসেসফুল হবেনই কিন্তু দেবুর ব্যাপারে ব্যর্থ হলে আমার সব স্বপ্ন, সাধনা…..
আমি ওঁকে কথাটা শেষ করতে দিলাম না, না না সে ভয় আপনার নেই।
.
এই পৃথিবীর অজস্র কোটি কোটি মানুষ আপন আপন কাজে নিমগ্ন। কবি কাব্য রচনা করেন, শিল্পী রূপ দেন তার মনের স্বপ্নকে, বৈজ্ঞানিক সাধনা করেন আপন গবেষণাগারে, সাহিত্যিক মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙক্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতার কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন। মাঠে-ঘাটে, অফিসে-আদালতে, কলকারখানায় অসংখ্য মানুষ সংগ্রাম করছেন দিন রাত্রি কিন্তু কেন? শুধুই কি অর্থ যশ প্রতিপত্তির জন্য? দুমুঠো অন্নের জন্য? না,কখনই নয়। আপন মুক্তির জন্য ঠাকুর রামকৃষ্ণ সাধনা করেননি, খ্যাতির জন্য বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহ দেননি, কিছু ফিরিঙ্গি সাহেবের প্রশংসার জন্যও রাজা রামমোহন সতীদাহ প্রথা রদ করতে উদ্যোগী হননি। মার্কস বা এডিসন বা অন্য কোনো মহাপুরুষই শুধু আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানব সভ্যতার ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করেননি। কোনো মানুষই করে না। সব কর্মকাণ্ডের পিছনেই, সাধনার অন্তরালে কিছু মানুষের কল্যাণ, ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। ডক্টর চৌধুরীর কথা শুনে, দেবব্রতর প্রতি ওঁর ভালোবাসা দেখে এই কথাগুলো আবার নতুন করে আমার মনে পড়ল।