কোনো মহারানী বা মহারাজার প্রিয় বান্ধবীর কিছু হলেই তার পাশের ঘরে ডাঃ চৌধুরীর থাকার ব্যবস্থা হতো। দুটো ঘরের মাঝখানে দরজা। যখন ইচ্ছা পেসেন্টকে দেখাশুনা করা যাবে। ডাঃ চৌধুরীর ঘরে ওষুধপত্র ইনজেকশন থাকত। হসপিটালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে টেলিফোন। ডাঃ চৌধুরী মনে মনে হাসেন, অস্বস্তি বোধ করেন, কিন্তু অসহায়। প্রাইভেট সেক্রেটারি সাহেবকে সব কথা জানালেন।উনি সুযোগ মতোমহারাজার কাছেও কথাটা তুললেন কিন্তু মহারাজা বললেন, নো নো নো।
তিন মাস কেটে গেল।
সেদিন রাত্রে মহারাজার ডিনার। কয়েকজন নিমন্ত্রিত। কোর্ট মিনিস্টার, প্রাইভেট সেক্রেটারি, তিনজন ডাক্তার, দুজন এ-ডি-সি, চীফ প্যালেস গার্ড কর্নেল হরকিষণ সিং আর সমস্ত মহারানী ও বান্ধবীরা। ডিনারের আগে ড্রিঙ্কস এলো কিন্তু মহারাজা কাউকে বেশি ড্রিঙ্ক করতে দিলেন না। বললেন, ডিনারের পরে গল্প করবেন। ডিনার শেষ হলো। তারপর মহারাজা একটা বিরাট ডায়মন্ডের আংটি আর একটা সোনার ঘড়ি ডাঃ চৌধুরীকে উপহার দিতেই সবাই চমকে উঠলেন। হিজ হাইনেস অনেককেই অনেক কিছু উপহার দেন কিন্তু এমন সুন্দর ও দামি উপহার বিশেষ কেউ পান না। মহারাজা হাসতে হাসতে সবাইকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, শুনেছিলাম ডাঃ চৌধুরীর চরিত্র নাকি ভালো নয়, সেজন্য মহারানী ও বান্ধবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার জন্য ডাঃ চৌধুরীকে অনেক সুযোগ দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল হরকিষণকে অর্ডার দিলাম মহারানী ও বান্ধবীদের ঘরের স্কাই লাইটের পাশে ক্যামেরা নিয়ে একজন প্যালেস গার্ড বসে থাকবে।
মহারাজের কথা শুনে সবাই হতবাক। মহারাজা থামলেন না, কর্নেলকে বলেছিলাম ডাঃ চৌধুরীর দুর্বল মুহূর্তের একটা ছবি নিতে পারলে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেব। কিন্তু পুরস্কারের টাকা আমি কাউকে দিতে পারলাম না বলে আমি আনন্দিত ও গর্বিত।
এরপর শুরু হলো ড্রিঙ্কস, আনন্দ হুল্লোড়। মহারাজা একটা স্কচের গেলাস নিয়ে ডাঃ চৌধুরীকে বললেন, আজ একটু টেস্ট করবে নাকি?
.
দেবব্রত আমার হাতটা চেপে ধরে বললো, জানেন, বড়দাদু কি বলেছিলেন?
কি?
বলেছিলেন ইওর হাইনেস, আপনার হুকুম অমান্য করতে পারি, কিন্তু অনুরোধ উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার নেই।
আমি কৌতূহল চাপতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, মহারাজা কি বললেন?
না, মহারাজ অনুরোধ করেননি। কোনোদিন করেননি।
কর্নেল হরকিষণ সিং এখনও জীবিত। সোলনে থাকেন। অনেক বয়স হয়েছে। চুল দাড়ি সাদা ধবধবে। তার কাছে গেলে এখনও ডাঃ চৌধুরীর অনেক গল্প শোনা যায়। কাপুরতলা বা সিমলার আরো অনেকের কাছে শোনা যায়, জানা যায়।
বড় দাদুর খুব ইচ্ছা ছিল কলকাতায় থাকার, কিন্তু পারেননি। কাপুরতলার মহারাজকে ছেড়ে আসতে পারেননি। তাছাড়া এত লোকের সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব, হৃদ্যতা হয়েছিল যে তাদের সবাইকে ছেড়ে আসাও অসম্ভব ছিল।
আমি বললাম, তা তো বটেই।
দেবব্রত বললো, বড় দাদুর জন্য আমার দাদুও প্রায় কাপুরতলা বা সিমলা আসতেন। তারপর আস্তে আস্তে উনিও একদিন সিমলার বাসিন্দা হয়ে গেলেন।
০৩. পনের বছর আগেকার ঘটনা
পনের বছর আগেকার ঘটনা। ছোটখাট অনেক ঘটনাই মনে নেই, ভুলে গেছি। তবে মনে আছে দেবব্রত চৌধুরী তিন-চারদিন আমার হোটেলে এসেছে, গল্প করেছে, খেয়েছে। একদিন কথায় কথায় বললো, আপনার সঙ্গে আগে আলাপ হলে আমি নিশ্চয়ই জার্নালিস্ট হতাম।
আমি হাসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?
কেন নয় বলুন? চাকরি করলেও দাসত্বের শৃঙ্খল নেই, তাছাড়া কি দারুণ একসাইটিং অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং কাজ বলুন তো?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। একটু চাপা হাসি হাসতে হাসতে হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিলাম। ও কিছু শুনতে চাইছিল। আমার নীরবতা বোধহয় ভালো লাগছিল না। কি হলো? কিছু বলছেন না শুধু হাসছে?
এবারে আমি জবাব দিলাম, আমি যদি ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীর ভাই হতাম তাহলে আমি নিশ্চয়ই ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়তাম,আবার একটু হুইস্কি গলায় ঢেলে বললাম, আদার্স লন ইজ
অলওয়েজ গ্রীনার, তাই না?
দেবব্রত বললো, যাই বলুন জার্নালিস্টদের রেসপেক্টই আলাদা। তাছাড়া দারুণ গ্লামারস প্রফেশন।
এককালে সত্যি সাংবাদিকদের সম্মান ছিল কিন্তু এখন নেই।
কেন?
থাক। এসব আলোচনা না করাই ভালো।
দেবব্রত আর তর্ক করেনি। ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়তে অবশ্য আমার ভালোই লাগছে। ভারি ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট।
.
আমি সাংবাদিক। সংবাদপত্রের পরিভাষায় স্পেশাল করসপনডেন্ট। বিশেষ সংবাদদাতা। প্রাইম মিনিস্টার মিনিস্টার এম পি-দের নিয়েই আমার কারবার। পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল হলে আড্ডা দিই। চা কফি সিগারেট। পরনিন্দা-পরচর্চা। নোট বই-পেন্সিল-টাইপ রাইটার। টেলিফোন, ট্রাংকল। টেলিপ্রিন্টার-টেলেক্স। দিনটা এইভাবেই কাটে। সন্ধ্যার পর কালো স্যুট টাই। হায়দ্রাবাদ হাউস অথবা অশোকা হোটেল। অথবা ডিপ্লোম্যাটিক পার্টি। রিসেপসন। স্কচ। ওয়াইন। অথবা ভডকা। তবুকান সতর্ক থাকে। নতুন গোপন কোনো খবর পেলেই পাঠিয়ে দেব অফিসে। ছাপা হবে পরের দিন সকালের কাগজে।
এই ত আমার, আমাদের দিল্লির জীবন। কখনও কখনও বাইরে যেতে হয়। দূরে, কাছে। বাসে ট্রেনে মোটরে প্লেনে। কখনও পাড়ি দিতে হয় বিদেশ। ছায়ার মতো অনুসরণ করতে হয় ভি আই পিদের। কত কি দেখি, শুনি, জানতে পারি কিন্তু রাজনৈতিক দুনিয়ার বাইরের কোনো কিছু জানি না বললেই চলে। বিভিন্ন রাজ্যের ডজন ডজন মন্ত্রী বা নেতাদের নাম আমাদের মুখস্থ কিন্তু কলকাতা দিলি বোম্বে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন ভাইস-চ্যান্সেলারের নাম জানেন, এমন সাংবাদিক ভারতবর্ষে নেই বললেই চলে। তবু কিছু কিছু সাহিত্যিক বৈজ্ঞানিকের খবর আমাদের রাখতে হয়। নানা কারণে, নানা উপলক্ষ্যে এদের জানতে হয়, চিনতে হয়। তিন মূর্তি ভবনে বা সাউথ ব্লকের অফিসে প্রাইম মিনিস্টার মাঝে মাঝেই দুচারজন বৈজ্ঞানিক বা অর্থনীতিবিদ বা ওই ধরনের কিছু জ্ঞানী-গুণীকে আমন্ত্রণ জানান। আলোচনা করেন, পরামর্শ করেন। প্রাইম মিনিস্টারের ঘর থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এদের ঘিরে ধরি, প্রশ্ন করি। এক্সকিউজ মী স্যার, কাশ্মীর ক্রাইসিসের জন্য কি ফাইভ ইয়ার প্ল্যানের কিছু মেজর চেঞ্জ হচ্ছে?