নরহরি মদ্যপান করতেন কিনা বা বাইজিদের সঙ্গে তার কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিনা, তা কেউ জানে না। তবে একথা সবাই জানে জাল নথিপত্রে সাহেবের দস্তখত করিয়ে নেবার ফলেই দীনদুঃখী নরহরি আহিরীটোলার বিরাট সম্পত্তির মালিক হয়। আস্তে আস্তে আরো অনেক কিছু হলো। আহিরীটোলার সম্পত্তি ছাড়াও নিমতলা আর কালীঘাটের অনেক বাড়ি ও জমিজমা হলো। হুগলির গ্রামের বাড়ি পাকা করার সময় হলো না নরহরির, কিন্তু সে অপূর্ণ কাজ পূর্ণ করলেন তার ছেলে শ্রীহরি চৌধুরী।
দেবব্রত হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আগে আমাদের দেশের কোনো বড়লোকই বোধহয় জোচ্চুরি না করে বড়লোক হননি।
এখনও কি জোচ্চুরি না করে আমাদের দেশে বড়লোক হওয়া যায়? এক চুমুক হুইস্কি খেয়ে বললাম, আগে শুধু জমির মালিকানা এদিক-ওদিক করে বড়লোক হতো, এখন ব্যবসা বাণিজ্য সম্পত্তি সব কিছু নিয়েই জোচ্চুরি করে বড়লোক হচ্ছে।
তবে মাই ফোর ফাদার নরহরি ওয়াজ এ গ্রেট স্কাউনড্রেল!
চৌধুরীবাড়ির দীর্ঘ ইতিহাস দেবব্রত জানে না। তবে শুনেছে অনাচার ব্যভিচারের জন্য আস্তে আস্তে চৌধুরীবাড়ির গৌরব ম্লান হতে শুরু করল। বৃন্দাবন চৌধুরী নিজে বিশেষ লেখাপড়া না জানলেও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। শোনা যায় স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের জন্য উনি নিমতলার একটা বাড়ি আর নগদ পাঁচ শ টাকা বিদ্যাসাগর মশাইকে দিয়েছিলেন। বহু আত্মীয়স্বজনের পরামর্শ উপেক্ষা করে উনি তার বড় ছেলে জনার্দনকে ডাক্তারি পড়ার জন্য বিলেতে পাঠালেন। সাত-আট বছর পর আহিরীটোলার বাড়িতে যেদিন বিলেত থেকে খবর এলো জনার্দন পাস করেছে, সেদিন বৃন্দাবন চৌধুরী বেঁচে নেই। স্ত্রী বহু আগেই গত হয়েছিলেন। আহিরীটোলার বাড়িতে তখন জনার্দনের ছোট ভাই গদাধর কিছু দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের নিয়ে থাকেন আর কলেজে এফ-এ পড়ছেন।
ডাক্তারি পাস করার পরও জনার্দন বিলেতে থেকে গেলেন। লেখাপড়া করার জন্য উনি ছোট ভাইকেও বিলেত যেতে বললেন কিন্তু আত্মীয়দের অনুরোধে ও কিছু বন্ধু বান্ধবের চাপে গদাধর কলকাতাতেই থেকে গেলেন। বিশেষ করে হেমন্ত মামা কিছুতেই যেতে দিলেন না। হেমন্ত সরকার আপন মামা না হলেও বৃন্দাবন চৌধুরীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। বৃন্দাবনবাবুর মৃত্যুর পর ইনিই সম্পত্তির দেখাশুনা করতেন। সুতরাং তার পরামর্শ উপেক্ষা করা গদাধরের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আরো একটা বিশেষ কারণ ছিল। বাবা-মা নেই, দাদা বিলেতে। কিছু নেই নেই করেও আহিরীটোলা-নিমতলার সাতখানা বাড়ি ছাড়াও সামান্য কিছু শেয়ার আর বেশ কিছু সোনাদানার মালিক। কিছু রসিক বন্ধুবান্ধব গদাধরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করেছিল। এমন সময় হেমন্ত মামা তার এক দূর সম্পর্কের শালীর সঙ্গে গদাধরের বিয়ের প্রস্তাব আনলেন। ক্ষিদের মুখে হাতের কাছে পাকা আমটি পেয়ে গদাধর মামার প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে পারলেন না।
এই গদাধর চৌধুরীই আমার দাদু।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
তারপর?
বছর দুই পরে বড় দাদু দেশে ফিরলেন। ঠিক করেছিলেন কলকাতায় প্র্যাকটিশ করবেন, কিন্তু জাহাজে আসার সময় সব প্ল্যান উল্টে গেল।
কেন?
দেবব্রত হাসল। ঐ জাহাজেই কাপুরতলার মহারাজাও দলবল নিয়ে বিলেত থেকে দেশে ফিরছিলেন। মহারাজার এক প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে বড়দাদুর আলাপ হয়। মহারাজার কাছ থেকে ছুটি পেলেই উনি বড় দাদুর সঙ্গে গল্প করতেন। কখনও কেবিনে, কখনও আপার ডেকে। কখনও আবার বার-এ। রাজাদের রাজপ্রাসাদের গল্প শুনতে বড় দাদুর ভারি মজা লাগত।…
.
মহারাজার পার্সোন্যাল পার্টির জন্য ছটা ফার্স্ট ক্লাস কেবিন ছিল। মহারাজা নিজে একটা স্পেশ্যাল ডিলক্স কেবিনে ছিলেন। এছাড়া কয়েকজন সাধারণ কর্মচারী সেকেন্ড ক্লাস কেবিনে ছিলেন। ডাঃ জনার্দন চৌধুরী দেখেশুনে অবাক। মহারাজা কি ফ্যামিলি নিয়ে ট্রাভেল করছে?
প্রাইভেট সেক্রেটারি হাসলেন, ফ্যামিলি নিয়ে মহারাজা বিলেত যাবেন? ফ্যামিলি নিয়ে গেলে কি আনন্দ হয়?
দেন হু আর ট্রাভেলিং উইথ হিম? এতগুলো কেবিনে কারা যাচ্ছেন?
ডিল্যুক্স কেবিনে হিজ হাইনেস। চারটি ফার্স্টক্লাস কেবিনে মহারাজার চারজন গার্ল ফ্রেন্ড, ফিফথ কেবিনে আমি আর অন্যটিতে হিজ হাইনেসের একজন এ-ডি-সি।
চারজন গার্ল ফ্রেন্ড?
প্রাইভেট সেক্রেটারি সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, হিজ হাইনেস হ্যাঁজ গট ফোর হানড্রেড গার্ল ফ্রেন্ড।
মাই গড!
মহারাজাস আর লাইক দ্যাট।
সত্যি? সত্যি।
ডাঃ চৌধুরী স্তম্ভিত হয়ে চুপ করে ভাবেন। একটু পরে জিজ্ঞাসা করলেন, সেকেন্ড ক্লাস কেবিনে কারা আছেন?
গার্ল ফ্রেন্ডদের দুজন লেডি অ্যাটেনডান্ট, হিজ হাইনেসের চারজন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্ট, আমার একজন অ্যাটেনডান্ট আর একজন ট্রেজারী অফিসার।
এই জাহাজেও চারজন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্ট চাই মুহারাজার?
দিস ইজ দি লিস্ট রিকয়ারমেন্ট। হিজ হাইনেস যখন প্যালেসে থাকেন তখন প্রত্যেক সিফট এ পঞ্চাশ জন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্ট ডিউটি দেয়।
মন্থর গতিতে জাহাজ চলে। এক পরিবেশ, এক দৃশ্য দেখে দেখে যাত্রীর দল ক্লান্ত হলেও ডাঃ জনার্দন চৌধুরীর দিনগুলো বেশ কেটে যায়। এই চারজন পার্সোন্যাল অ্যাটেনডান্টের কি কাজ?