দেবু উন্মাদ না হলেও প্রায় পাগলের মতো হেসে উঠল, হইনি। হলে ভালোই হতো।
বেশ রেগে আমি ওকে বললাম, গেট রিড অব অল দিজ ডার্টি আইডিয়াস।
আই উইস, আই কুড, কিন্তু যা বলছি তা বর্ণে বর্ণে সত্যি। রঞ্জনা নিজেও স্বীকার করেছে।
বলেন কি?
হ্যাঁ। ও স্বীকার করেছে।
দুজনেই গেলাসের পর গেলাস হুইস্কি খেয়ে গেলাম। কিন্তু একটি কথা বললাম না কেউই। অনেকক্ষণ। বোধহয় ঘণ্টাখানেক। বা তারও বেশি।
আমার বড় দাদু ডাঃ জনার্দন চৌধুরীর কথা আপনার মনে আছে?
যিনি কাপুরতলার মহারাজার…
দ্যাটস রাইট। হি ওয়াজ এ গ্রেট ম্যান। কিন্তু আমার নিজের দাদু গদাধর চৌধুরী এক নম্বরের স্কাউলে ছিলেন। নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে সিমলার এক পাহাড়ি মেয়েকে নিয়ে ঘর করতেন।
আমি চুপ করে শুনছি। তখনকার দিনে অনেক বাঙালিবাবুই এ কাজ করতেন। শুনে অবাক হলাম না।
আমরা ওঁর ঐ রক্ষিতারই বংশধর।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমার বাবাকে বড় দাদুই মানুষ করেন এবং তিনি নিছক একজন ভদ্রলোক ছিলেন। বড় দাদুই আমার বাবার বিয়ে দেন এবং আমরা হই।
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললাম, আর কি শুনব আপনার কাছে?
দাদুর এসব কথা কাউকে বলি না। ভেবেছিলাম বলার দরকার হবে না। কিন্তু দাদার কাণ্ড দেখে। মনে হচ্ছে রক্তের ধারা পাল্টান বড় কঠিন। বোধহয় অসম্ভব।
জানি না।
আমার এক কাকা–আই মীন ওই পাহাড়ি মেয়েটির ছোট ছেলে–দিল্লিতে আন্ডার সেক্রেটারি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমাদের অনেক পরিচিত লোক এমনি পাহাড়ি মেয়েকে নিয়ে ঘর করতে করতে…
থাক, আর দরকার নেই। রঞ্জনা কি দিল্লিতেই আছে?
হ্যাঁ। দোতলায় থাকে। একতলা ভাড়া দিয়ে এগার শ টাকা পাচ্ছে।
টাকার হিসেব শুনতে চাইনি।
এমনি বলছিলাম। ওর সম্পর্কে আপনার চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক।
চিঠিপত্রের লেনদেন নেই নিশ্চয়ই?
। তবে পর পর কয়েকবার টাকা পাঠিয়েছি, কিন্তু ও নেয়নি।
না নেওয়াই তো উচিত।
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি পরশুই যাচ্ছেন?
কেন? আরো কিছু শোনাতে চান?
দেবব্রত উঠে দাঁড়াল। আমিও।ও একবার আমার দিকে তাকিয়েই দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার উপর রাগ করবেন না। আমি বড় দুঃখী। আমি বড় একা।
আমিও ওকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম, রাগ করিনি ঠিকই তবে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলেই ভালো হতো।
আমার কাঁধের উপর ফোঁটা ফোঁটা ওর চোখের জল পড়ছিল। হয়তো আপনার ভালো হতো, কিন্তু আপনাকে সব কিছু বলে একটু হালকা হতে পারলাম।
অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। বললাম, বাড়ি যান। অনেক রাত হয়েছে।
যাচ্ছি।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানেই থাকবেন না কি দেশে ফিরবেন?
দেশে ফেরার ইচ্ছা নেই। এখানেই বেশ আছি।
বেশ আর কোথায় আছেন?
যারা দেশে সুখে থাকতে পারে তারা কেউ লন্ডনে আসে না। আসবে কেন? পৃথিবীর যত দুঃখী লোকের ভিড় তত এই লন্ডনে। আমিও ওদের মধ্যে দিনগুলো ঠিক কাটিয়ে দেব।
.
অনেক দিন বিদেশে কাটিয়ে দিল্লি ফিরলাম। রাধাকিষণকে আগেই খবর দিয়েছিলাম। ও এয়ারপোর্টেও এসেছিল। পালাম থেকে বাড়ি ফেরার পথে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু জরুরী খবর। আছে নাকি?
।রাধাকিষণ বললো, অনেক চিঠিপত্র এসেছে আর চৌধুরী মেমসাব এসেছিলেন।
কবে এসেছিলেন?
তিন-চার দিন।
কিছু বলে গেছেন?
জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কবে আসবেন, আর একটা চিঠি দিয়ে গেছেন।
উনি জানেন আমি আজ আসছি?
হ্যাঁ সাব। আমি বলেছি।
চিঠি কবে দিয়ে গেলেন?
আজই।
বাড়িতে এসেই রঞ্জনার চিঠি পড়লাম।…যত রাত্রিই হোক একবার আমার এখানে আসবেন।
হাতের ঘড়িতে দেখলাম দশটা বেজে গেছে। মিনিট খানেক ভাবলাম। তারপরই একটা ট্যাকসি নিয়ে চলে গেলাম।
আমি ট্যাকসি থেকে নামতেই দেখি রঞ্জনা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাকসি ছেড়ে দিলাম না, ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বললাম।
এক পা এগুতেই রঞ্জনা বললো, আসুন।
আমি একটি কথা না বলে ওর পিছন পিছন উপরে উঠলাম। সামনের ঘরে ঢুকতেই বললো, বসুন।
বসলাম।
পাশের ঘর থেকে ছেলেকে কোলে করে এনে আমার সামনেই বসে পড়ে বললো, আজ এর জন্মদিন। আপনি যদি একটু আশীর্বাদ করতেন…
রঞ্জনা আর কথা বলতে পারল না।
আমি ওর কোল থেকে ছেলেটাকে দু হাতে তুলে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম।
আমার পায়ের উপর রঞ্জনার কয়েক ফোঁটা গরম চোখের জল পড়তেই ওকেও আমি বুকের মধ্যে টেনে নিলাম।